Advertisement
১৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Online Fraud Cases

অ্যাপের ফাঁদ, অনলাইন পুজোর নামেও প্রতারণা

সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, টেলিগ্রাম বা অন্য অ্যাপে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদ বাড়ছে। পুলিশ বলছে, এই পথেই গত তিন মাসে কলকাতায় টাকা খুইয়েছেন প্রায় পাঁচশো জন।

— প্রতীকী চিত্র।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৪:২৮
Share: Save:

প্রতারণার ফাঁদ পাতা ভুবনে। অ্যাপ-ভুবনে।

সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, টেলিগ্রাম বা অন্য অ্যাপে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার নামে প্রতারণার ফাঁদ বাড়ছে। পুলিশ বলছে, এই পথেই গত তিন মাসে কলকাতায় টাকা খুইয়েছেন প্রায় পাঁচশো জন। খোয়া গিয়েছে প্রায় ৫০ কোটিরও বেশি টাকা। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মূলত ক্রিপ্টোকারেন্সি (বেসরকারি ভার্চুয়াল মুদ্রা) এবং শেয়ার বাজারের নতুন নতুন আইপিও-তে বিনিয়োগের নামে ফাঁদ পাতা হয়। টেলিগ্রামের মতো অ্যাপে যে হেতু তথ্য সংরক্ষিত থাকে না এবং গ্রাহক সুরক্ষার দোহাই দিয়ে এই অ্যাপ কর্তৃপক্ষ যে হেতু তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদান করেন না, তাই এমন অপরাধে অপরাধীকে ধরাও মুশকিল। সাইবার গবেষক সন্দীপ সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘অপরাধীরা ওই বিশেষ অ্যাপের একটা গ্রুপে কথা বলে। প্রত্যেকেই হয়তো প্রতারণা সিন্ডিকেটের লোক। একমাত্র প্রতারিত হচ্ছেন সিন্ডিকেটের বাইরের লোক। শুরুতে বিনিয়োগ করেই মোটা টাকা পেয়েছেন বলে অনেকে বলাবলি করছেন, এমন শোনা যায় সেখানে। কিন্তু টাকা তোলার সময় এলে বিনিয়োগ করা টাকা তো পাওয়া যায়ই না, উল্টে সার্ভিস চার্জ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ট্যাক্সের নাম করে নেওয়া হয় আরও হাজার হাজার টাকা।’’

এমনই প্রতারণা চক্রের রমরমার অভিযোগ সম্প্রতি সামনে এসেছে পূর্ব বর্ধমানের কালনা মহকুমায়। অভিযোগ, বিদেশি সংস্থার সামগ্রী উৎপাদনে অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করলে প্রচুর মুনাফা পাওয়া যাবে বলে ফাঁদ পাতা হয় সেখানে। অনেকেই এমন অ্যাপের গ্রুপে যুক্ত হয়ে বিনিয়োগ করেন। গোড়ায় দু’-এক বার টাকা ফেরতও পান কেউ কেউ। এর পরে সমস্তটাই হাওয়া! এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘‘হঠাৎ দেখি গ্রুপ বন্ধ। আমায় বার করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশে জানিয়েও সুরাহা হয়নি।’’

একই রকম প্রতারণার অভিযোগ রাজ্যের জেলায় জেলায়। বিদ্যুতের বিলের বকেয়া মেটানোর নামে, বিমার বা কার্ডের মেয়াদ শেষের নামে, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি পাইয়ে দেওয়ার নামে, নয়তো চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার ঘটনা সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। খড়্গপুর শহরের ইন্দায় এমনই চাকরি দেওয়ার নামে কনসালটেন্সি এজেন্সি চালানোর অভিযোগ সামনে এসেছে সম্প্রতি। বিষয়টি জানাজানি হতেই অফিসে তালা ঝুলিয়ে বেপাত্তা হয়ে যায় এজেন্সির কর্তারা। পুলিশে অভিযোগ হলেও এখনও কিনারা হয়নি। একই ভাবে নদিয়ার কল্যাণী এমস হাসপাতাল বা বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা তোলার অভিযোগ সামনে এসেছে। ব্যাঙ্কের তথ্য হাতিয়ে প্রতারণার ঘটনায় তদন্তকারীরা এমন অনেক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করেছেন, যেগুলির গ্রাহকেরা মৃত। আবার ওই গ্রাহকদের যে ঠিকানা ব্যাঙ্কের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাস্তবে তার অস্তিত্বই নেই।

আবার রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি দেওয়ার নামে গ্রাহকদের ফোন করে ওটিপি হাতিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পশ্চিম মেদিনীপুরে। মালদহে আবার বেশ কিছু জায়গা থেকে ব্যাঙ্কের নামে ফোন করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সামনে এসেছে। উত্তর দিনাজপুর পুলিশ সূত্রের খবর, সম্প্রতি ৬০টিরও বেশি সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে, যেখানে ব্যাঙ্কের নামে গোপন তথ্য ও ওটিপি জেনে টাকা হাতানো এবং মহিলাদের ছবি বিকৃতি-সহ নানা অভিযোগ রয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটে মাসখানেক আগে এক স্কুল শিক্ষককে ভিডিয়ো কল করার পরে তাঁর তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। এই জেলায় পুলিশ কর্তাদের নাম করেও সমাজমাধ্যমে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খোলার অভিযোগ সামনে এসেছে। একই রকম অভিযোগ বাড়ছে মুর্শিদাবাদে। বহরমপুরের সাইবার থানায় মাসে গড়ে তিনশোটি করে অভিযোগ জমা পড়ছে। বীরভূমের বিভিন্ন জায়গা থেকে বিদ্যুৎ দফতরের পরিচয় দিয়ে, গ্যাসের ভর্তুকির নামে তথ্য জেনে নিয়ে, এমনকি, তারাপীঠে অনলাইনে পুজো দেওয়ার নাম করেও টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছেবলে অভিযোগ।

গত সেপ্টেম্বরেই সাইবার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে মৃত্যু হয় উত্তরপ্রদেশ থেকে বিশ্বভারতীতে পড়তে আসা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী অনামিকা সিংহের। একই মাসে সিবিআই পরিচয় দিয়ে অনলাইনে ভয় দেখানোয় প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকার সাইবার প্রতারণার শিকার হন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী, পূর্বপল্লির বাসিন্দা গায়িকাসুনিধি নায়েক।

এমনও উদাহরণ সামনে আসছে যেখানে তাঁর সংস্থার নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা, অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জানেনই না। পরে খোঁজ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, দিন কয়েক আগেই ব্যাঙ্ক-ঋণ সংক্রান্ত বিষয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। ঋণ যে চান না, তা-ই একটি অনলাইন ফর্ম পূরণ করে জানাতে বলা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে। তদন্তকারীরা দেখেন, ফর্ম পূরণের নামে একটি নজরদারি অ্যাপ নামানো হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল ফোনে। এরপর ফোনের সম্পূর্ণ দখল পেয়ে যায় প্রতারকেরা। তখন আর প্রয়োজনও পড়ে না ওটিপি চাওয়ার।

সাইবার গবেষক নিশীথ দত্ত বলছেন, ‘‘হয়তো ফোন পকেটে ভরে কেউ অন্য কাজ করছেন। তার মধ্যেই টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, ব্যাঙ্কের টাকা কাটার মেসেজও ডিলিট করে দেওয়া হচ্ছে। পরে ফোন হাতে নিয়েও সেই কারণে আর বোঝারও কিছু থাকছে না। যত দিনে ব্যাঙ্কের পাস বই দেখা হচ্ছে, অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।’’ কিন্তু প্রতারিত ব্যক্তি পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি ফোনের ‘ট্রু-কলার অ্যাপে’ দেখে নিয়েছিলেন, ব্যাঙ্কের ঋণ সংক্রান্ত দফতর থেকেই তাঁকে ফোনটি করা হয়েছিল। সাইবার গবেষকদের দাবি, নতুন সিম কার্ড চালু হওয়ার পরে যে নামে সেই নম্বর লোকে ফোনে সেভ করে রাখছে, সেই পরিচয়টাই ট্রু-কলারের মতো অ্যাপ নেয়। সে ক্ষেত্রে প্রতারক একটা সিম চালু করিয়ে যদি দশটি ফোনে ব্যাঙ্কের ঋণ সংস্থার নাম দিয়ে সেভ করায়, তা হলে সেই নম্বরটি থেকে ফোন করলে ব্যাঙ্কের নাম দেখাতে বাধ্য।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Online fraud Online Transaction Financial Fraud
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy