Advertisement
E-Paper

বন্ধ ঘরে অপেক্ষায়, ওঁরা এসেছেন ভোট করাতে

তিনতলা বাড়িটার দরজা-জানালা সব বন্ধ। ভিতরে যে কেউ থাকতে পারে, বাইরে থেকে বোঝার জো নেই। শুক্রবার দুপুর। আসানসোলে এসবি গড়াই রোডে সেন্ট মেরি গোরেটি স্কুলের উল্টো দিকে দুর্গা ম্যানসন ঘুমন্ত পুরীর মতো দাঁড়িয়ে। পাশে দু’একটা দোকান শুধু খোলা।

সুশান্ত বণিক

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৬
বহিরাগতদের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসানসোলের এসবি গ়ড়াই রোডের একটি বাড়িতে। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র।

বহিরাগতদের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসানসোলের এসবি গ়ড়াই রোডের একটি বাড়িতে। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র।

তিনতলা বাড়িটার দরজা-জানালা সব বন্ধ। ভিতরে যে কেউ থাকতে পারে, বাইরে থেকে বোঝার জো নেই।

শুক্রবার দুপুর। আসানসোলে এসবি গড়াই রোডে সেন্ট মেরি গোরেটি স্কুলের উল্টো দিকে দুর্গা ম্যানসন ঘুমন্ত পুরীর মতো দাঁড়িয়ে। পাশে দু’একটা দোকান শুধু খোলা।

‘‘দাদা, এ বাড়িতে আজ-কালের মধ্যে অচেনা লোক ঢুকতে দেখছেন?’’

চারদিক দেখে এক দোকানি নিচু গলায় বলেন, ‘‘কাল (বৃহস্পতিবার) রাতে বেশ কিছু লোক ঢুকেছে। কিন্তু সকাল থেকে সাড়াশব্দ নেই।’’

এই সেই বাড়ি, গত লোকসভা ভোটের সময়ে যেখানে টানা এক মাস ঘাঁটি গেড়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী দোলা সেন। এখানেই ছিল তাঁর নির্বাচনী অফিস। দোলার সঙ্গে আসা শ’খানেক কর্মী-সমর্থকও এখানেই থাকতেন।

সকাল থেকে কানাঘুষো— শনিবার আসানসোলে ‘ভোট করাতে’ বহিরাগত লোকজনকে এনে এখানেই তুলেছে তৃণমূল। সত্যি-মিথ্যে জানার উপায় কী? দরজা তো বন্ধ!

হঠাৎই চোখে পড়ে, ম্যানসনের পিছন দিকের শাটার তুলে এক জন বেরিয়ে আসছেন। সঙ্গী চিত্রগ্রাহককে নিয়ে সেখান দিয়েই ঢুকে পড়া গেল।

আর ঢুকেই চোখ কপালে! ভিতরে থিকথিক করছে লোক। দোতলা আর তিনতলার বড় হলঘরে ডেকরেটরের তোষক-কম্বলের ঢালাও বিছানা। অনেকেই শুয়ে-বসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। ঘুরে-ফিরেও বেড়াচ্ছেন অনেকে।

‘‘কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?’’

প্রায় সমস্বরে উত্তর এল, ‘‘আরে না না, বন্দোবস্ত ঠিকই আছে।’’

‘‘ফুচুদা (শহরের পরিচিত তৃণমূল নেতা) এসেছিলেন না কি?’’

জবাব আসে, ‘‘হ্যাঁ, সকালেই তো এক বার ঘুরে গিয়েছেন।’’

আরও খানিক এ কথা-সে কথার পরে এক জনের খানিক কাছ ঘেঁষে জিগ্যেস করা গেল, ‘‘দাদার নামটা?’’

—উৎপল খাটুয়া।

‘‘স্নান-টান হয়ে গিয়েছে?’’

—হ্যাঁ, প্রায় সবাই করে নিয়েছে। কয়েক জন বাকি।

‘‘এ বার খাবেন তো, না কি?’’

—হ্যাঁ, ওই তো ওরা নীচ থেকে খাবার আনতে গিয়েছে।

রান্নাবান্না হচ্ছে নীচে রসুইঘরে। হলঘরের পিছনের দিকে পাত পেড়ে বসে গিয়েছেন অনেকে। একটু বাদেই বড় ডেকচি করে খাবার এল।

মেনু কী?

‘‘খিচুড়ি, গোটা ডিম ভাজা আর শশা-পিঁয়াজ’’— জবাব দিলেন রাহুল সির্দি নামে এক জন। খানিক আগেই আলাপ হয়েছে, যেমন হয়েছে অর্জুন পান নামে এক যুবকের সঙ্গেও। ওঁরা এসেছেন বর্ধমানেরই মেমারি থেকে।

‘‘আপনারা কাল এলেন কেন?’’

অর্জুন: ভোট করাতে। এখানে আছি একশো জনের মতো, বাকিরা অন্য জায়গায় আছে।

‘‘কোথা থেকে এসেছে সব?’’

অর্জুন: মেমারি, কাটোয়া, সবং... বীরভূম থেকেও এসেছে কিছু।

কথাবার্তা ভালই এগোচ্ছিল। ওঁরা তত ক্ষণে প্রায় ধরে নিয়েছেন, ‘এরা আমাদেরই লোক।’ তাল কাটল সঙ্গী চিত্রগ্রাহক ক্যামেরা বের করতেই। পরের প্রশ্নটা ছিল: ‘‘এখানে কে নিয়ে এল আপনাদের?’’

জবাব নেই। বেশ কিছু চোখ শুধু স্থির তাকিয়ে। পাশ থেকে ক্লিক, ক্লিক, ক্লিক... দ্রুত শাটার পড়ছে ক্যামেরায়।

ভিতরের ঘর থেকে নেতা গোছের এক জন বেরিয়ে আসেন। খালি গা, পরনে শর্টস। বেরিয়েই চিৎকার— ‘‘এই, তোরা সরে যা, সরে যা! একটাও কথা বলবি না!’’ তার পরেই সোজা নিশানা— ‘‘আপনারা এ বার যান তো দাদা! যান, যান!’’

গতিক সুবিধের নয়। পায়ে-পায়ে বেরিয়ে আসতেই হয়।

পরে নানা এলাকা ঢুঁড়ে জানা যায়, আসানসোলে কল্যাণপুর স্যাটেলাইট টাউনশিপ প্রজেক্ট এলাকা, কল্যাণপুর কমিউনিটি সেন্টার, বার্নপুরে রামবাঁধ লাগোয়া রাজমহল, ইস্কো হোটেল, কুলটির লছিপুর এবং ৭১ নম্বর ওয়ার্ড লাগোয়া এলাকায় প্রচুর বহিরাগত ইতিমধ্যেই মোতায়েন। বিরোধীদের অভিযোগ, পুরুলিয়া এবং ঝাড়খণ্ড থেকেও লোকজন আনা হয়েছে। ভোট লুঠ, মারদাঙ্গার দায়িত্বে আছেন এঁরাই।

আসানসোলের নেতা, শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের অবশ্য দাবি,

‘‘এ সব বিরোধীদের অলীক কল্পনা।’’ স্বচক্ষে যা দেখলাম? মলয়বাবুর জবাব, ‘‘আমাদের কাছে এমন কোনও খবর নেই।’’ তাঁর ভাই, শহরের দাপুটে নেতা অভিজিত ঘটককে (ফুচু) বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

প্রশাসনের নির্দেশ, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার পরে ভোটার নন, এমন কেউ আসানসোল পুর এলাকায় থাকতে পারবেন না। এই নিয়ে কিছুটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন আসানসোলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। রাতে তাঁর কটাক্ষ, ‘‘ওরা (তৃণমূল) ভয় পেয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে! না হলে বাইরে থেকে লোক আনতে হবে কেন?’’

সাধারণ হিসেবে, আসানসোল শহরে অন্তত তৃণমূলের ভয় পাওয়ার কথা নয়। বিগত পুরবোর্ড থেকে দুই বিধায়ক, সবই তাদের। তবে সাবেক আসানসোল পুরসভার সঙ্গে যে তিন পুরসভা যুক্ত করে আসানসোল কর্পোরেশন গড়া হয়েছে, তার মধ্যে শুধু কুলটিই তাদের দখলে ছিল। বাকি জামুড়িয়া ও রানিগঞ্জে সিপিএমের যথেষ্ট শক্তি রয়েছে।

বহিরাগতরা যে এসেছে, তার যথেষ্ট ইঙ্গিত তৃণমূলের আসানসোল জেলা সভাপতি ভি শিবদাসনের কথায়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আসানসোলে আমাদের দু’চার জন বহিরাগত যদি এসেও থাকে, সিপিএমও তো লোক এনেছে! জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ ওদের আনা লোকজনে ভরে গিয়েছে।’’

সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য বংশগোপাল চৌধুরী পাল্টা বলেন, ‘‘লোক এনে ভোট করানোর দরকার আমাদের হয় না। বরং জামুড়িয়ায় আমাদের লোকজনকেই মারধর করা হচ্ছে, রানিগঞ্জে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।’’

হিমশৈলের চুড়ো তো দেখা হয়েই গিয়েছে। বাকিটা বোঝা যাবে ভোট শুরু হলে।

Outsider Asansol Municipal election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy