Advertisement
E-Paper

জলতলে কপিলমুনির মন্দিরে যাব কোন পথে

‘‘পানি কে অন্দরওয়ালা মন্দির জানে কা রাস্তা কৌন সা হ্যায়?’’ জলের ভিতরের মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা ঠিক কোনটা? মকরসংক্রান্তির প্রাক্কালে পুণ্যস্নান করতে আসা এক ভক্তের জিজ্ঞাসা।

মধুরিমা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৯
পুণ্যের পথে। বৃহস্পতিবার গঙ্গাসাগরে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

পুণ্যের পথে। বৃহস্পতিবার গঙ্গাসাগরে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

‘‘পানি কে অন্দরওয়ালা মন্দির জানে কা রাস্তা কৌন সা হ্যায়?’’

জলের ভিতরের মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা ঠিক কোনটা?

মকরসংক্রান্তির প্রাক্কালে পুণ্যস্নান করতে আসা এক ভক্তের জিজ্ঞাসা।

কপিলমুনির মন্দির ছাড়া সেই অর্থে অন্য কোনও মন্দির নেই সাগরদ্বীপের এই চত্বরে। কিন্তু শুধু ওই ভক্ত নয়, আরও অনেক পুণ্যার্থীরই বদ্ধমূল বিশ্বাস, সমুদ্রের গভীরে এখনও কপিলমুনির দু’-দু’টি রহস্যময় মন্দির আছে। সব তীর্থ বারবার হলেও গঙ্গাসাগর তো এক বারই। তাই সাগরে পুণ্যার্জন সম্পূর্ণ করার তাগিদে জলগর্ভের সেই মন্দিরে যাওয়ার জন্য ভক্তপ্রাণের এই আকুলতা।

ভক্তের প্রত্যয় অটল। তবে কপিলমুনির আশ্রমের প্রধান পুরোহিত জ্ঞানদাস মোহন্ত জানাচ্ছেন, বহু যুগ আগে কপিলমুনির মন্দিরের অবস্থান ছিল সমুদ্রের খুব কাছে। সমুদ্রের ঢেউয়ে প্রায় ডুবে যাওয়া মন্দির সরানো হয় অন্যত্র। কিন্তু তাতেও সমস্যা না-মেটায় বর্তমানের এই জায়গাটিতে নতুন করে গড়ে তোলা হয় কপিলমুনির আশ্রম।

মোহন্ত জানান, মন্দিরের উন্নয়নের খরচ আসে অযোধ্যা থেকে। একই ভাবে কপিলমুনির আশ্রমে আগত ভক্তদের টাকা চলে যায় অযোধ্যার রামমন্দিরে। যুগের পর যুগ এখানে এই বিপুল ভক্তসমাগম কেন?

‘‘অন্য তীর্থের তুলনায় এখানেই কৃচ্ছ্রসাধন করতে হয় বেশি। তাই পুণ্যার্জনের সুযোগ সব থেকে বেশি এখানেই,’’ ব্যাখ্যা মোহন্তের।

মন্দিরের সামনে যত দূর চোখ যায় পুণ্যকামীর ভিড়। মাথায় বোঝা নিয়ে, নুয়ে-ঝুঁকে পড়ে, কেউ খুঁড়িয়ে, কেউ বা সন্তান কোলে, কেউ দু’হাত তুলে ‘কপিলমুনির জয়’ বলতে বলতে পুজোর ডালা হাতে চলেছেন মন্দিরের দিকে। কড়া নিরাপত্তার ব্যারিকেডে আটক আরও কয়েক লক্ষ মানুষ।

পুণ্যস্নানের টানে মাথায়, বগলে বাক্স-পোঁটলা ঝুলিয়ে সারি সারি মানুষের সাগরমুখী অভিযাত্রা শুরু হয়েছে বুধবার মাঝরাতে। স্নান, গোদান পর্বও শুরু হয়ে গিয়েছে। আর তাতেই টের পাওয়া যাচ্ছে, ভক্তপ্লাবনে ভেসে যেতে চলেছে এ বারের গঙ্গাসাগর মেলা। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত লাখ বারো পুণ্যার্থী এসেছেন গঙ্গাসাগরে।

মন্দিরের সামনের চত্বর ঢেকে গিয়েছে প্রণামীতে। নারকেল ভাঙতে গিয়ে হয়তো ভিড়ের মধ্যে হাত ফস্কে নারকেলটাই পড়ে গেল। পরোয়া নেই। মুঠো করা চাল মন্দিরের উদ্দেশে ছুড়তে গিয়ে হয়তো পড়ল অন্য এক ভক্তের মাথায়। পরোয়া নেই। ঠেলাঠেলিতে হয়তো বা চশমাই হারিয়ে ফেললেন কেউ। ধূপের ছেঁকায় নাক পুড়়ল কারও। তাতে কিছুই যায়-আসে না। ক্ষণিকের জন্য মন্দিরের ইমারত ছুঁয়েই যাবতীয় সন্তাপ মুছে ফেলতে চাইছেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। ভিড়ের চাপে কোনও ভাবেই মাথা ঠেকাতে পারছিলেন না স্ত্রী। পরোয়া নেই। স্বামী তো পেরেছেন ছুঁতে, তাঁর সোয়েটার ধরেই পুণ্যের ভাগ নিলেন স্ত্রী।

মন্দিরের গা ঘেঁষে বসা নাগা সন্ন্যাসীদের থেকে বিভূতি নিচ্ছেন অনেকেই। নাঙ্গাবাবা দেখে লজ্জায় ঘোমটা দিলেন ঝাড়খণ্ডের এক গৃহবধূ। ‘‘আরে শরমাও মাত, আশীর্বাদ লো’’ বলতে বলতে স্ত্রীর হাত ধরে সন্ন্যাসীর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে দিলেন স্বামী।

আশ্রমের অন্য এক পুরোহিত জানান, ভক্তদের এমনই উন্মাদনা যে, নারকেল ভাঙতে গিয়ে অনেক সময় মন্দিরের দেওয়ালই ভেঙে দেন। কিন্তু এই ভিড়ে তো ঠিক করে পুজোই দেওয়া যায় না। কার অর্ঘ্য যে কার কাছে পৌঁছয়, তারও ইয়ত্তা নেই। তা হলে কেন এই জনপ্লাবন?

‘‘এটা মানুষের বিশ্বাস। এক বার চোখের দেখা দেখতে পেলেও মনে করে, সব পাওয়া হয়ে গেল। এতে যদি সে ভাল থাকে, কার কী বলার আছে! বিশ্বাসে তো সবই মিলায়,’’ বিশ্বাসী উচ্চারণ পুরোহিতের।

গঙ্গাসাগরে অনেকেরই অবশ্য এই প্রথম পুণ্যস্নান নয়। টানা ছ’বছর ধরে সাগরে আসছেন মোগলসরাইয়ের প্রকাশ ত্রিবেদী। পূর্ব মেদিনীপুরের পলাশ আচার্যের এই নিয়ে সাত বছর। অসুস্থ বাবা-মা আসতে না-পারায় তাঁদের হয়ে এ বছর পুণ্য করতে এসেছেন জবলপুরের কলেজছাত্র অম্বরীশ রাও। কোন আকর্ষণে তীর্থরাজের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ছত্তীসগঢ়ের যুবক, কেনই বা বিস্ময়ে হাতজোড় করে রাজস্থানের কিশোরী আউড়ে যাচ্ছে মন্ত্র, কী আশায় এক পায়ে লাঠি নিয়ে মাদুরাই থেকে মকরস্নানে এসেছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ— উত্তর মেলে না। কাশ্মীরের বৃদ্ধা গঙ্গায় ডুব দিতে দিতে অশ্রুগঙ্গা কেন মিশিয়ে দিচ্ছেন সঙ্গমের জলে— ব্যাখ্যা দেয়, কার সাধ্যি!

সারা ভারতের বিচিত্রভাষাভাষী মানুষ সাগরসঙ্গমে গড়ে তুলেছেন অন্য এক ভারত। জল-রঙে ফুটিয়ে তুলেছেন সনাতন ভারতের নিটোল চিত্র। সেই আমশিল্পীরা বিশ্বাসের চাকায় ভর করেই পাড়ি দিয়েছেন সাগরদ্বীপে। পেরিয়ে যাচ্ছেন যুগের পর যুগ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

pilgrims gangasagar madhurima dutta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy