Advertisement
০৮ মে ২০২৪
সাঁকরাইলে কিশোরী পাচার-কাণ্ড

কনে প্রশিক্ষণের নামে ধর্ষণ নাবালিকাকে

শুধু তো কিশোরীদের ‘টোপ’ দিয়ে নিয়ে গেলেই হবে না! তাদের ‘কনে’র মতো করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই বাজারে বাড়তে তার দাম। আর এই কনে গড়ার ‘প্রশিক্ষণে’র কাজটাই দক্ষতার সঙ্গে করত পাপ্পু। পুলিশকে এমনটাই জানিয়েছে মথুরা থেকে উদ্ধার হওয়া নাবালিকা।

ধৃত পাপ্পু।

ধৃত পাপ্পু।

নুরুল আবসার
শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ০১:৪৪
Share: Save:

শুধু তো কিশোরীদের ‘টোপ’ দিয়ে নিয়ে গেলেই হবে না! তাদের ‘কনে’র মতো করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই বাজারে বাড়তে তার দাম। আর এই কনে গড়ার ‘প্রশিক্ষণে’র কাজটাই দক্ষতার সঙ্গে করত পাপ্পু। পুলিশকে এমনটাই জানিয়েছে মথুরা থেকে উদ্ধার হওয়া নাবালিকা। তার অভিযোগ, কনের মতো গড়ে তোলার প্রশিক্ষণের নামে পাপ্পু তাকে একাধিক বার ধর্ষণ করেছে।

সেই ধর্ষণের অভিযোগে সোমবার রাতেই সাঁকরাইলের মানিকপুরে তার বাড়ি থেকে পাপ্পুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। হরিয়ানা-সহ নানা জায়গায় নাবালিকা পাচারের সঙ্গে পাপ্পুর নামে দেওয়া নাবালিকা ধর্ষণের মামলা। তাকে মঙ্গলবার হাওড়া আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে ১৪ দিন জেল হাজতে রাখার নির্দেশ দেন।

কে এই পাপ্পু?

শিকার থেকে শিকারিতে পরিণত হওয়ার পরে সাঁকরাইলের মানিকপুরেরই বাসিন্দা নাসিম কুরেশি ওরফে পাপ্পুকে বিয়ে করে সাহিদা বেগম ওরফে ট্যাঙ্কি। মাস তিনেক আগে তাদের বিয়ে হয়। পেশায় মাংস বিক্রেতা পাপ্পুও ক্রমে ভিড়ে যায় কিশোরী পাচার চক্রে।

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মেহফিজা বিবি নামে এক মহিলা বছর পাঁচেক আগে ট্যাঙ্কিকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গিয়ে উত্তরপ্রদেশে বিক্রি করে দিয়েছিল। সেখান থেকে পালিয়ে আসে সে। কিন্তু পুলিশকে সে এই ঘটনার কথা কিছু জানায়নি লোকলজ্জার ভয়ে। ফের সে পড়ে মেহফিজার খপ্পরে। আর যাতে সে পালাতে না পারে, তাই রণকৌশল বদল করে মেহফিজা। তত দিনে ট্যাঙ্কি সাবালিকা। চলনে-বলনে, চেহারা-কেতায় সে সপ্রতিভ। মেহফিজা তাকে বলে, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্যে পুরুষদের অনুপাতে মেয়েদের সংখ্যা অনেক কম। যদি সেখানকার পুরুষদের সে ‘বিয়ে’ করে, তা হলে যে টাকা মিলবে, তার ভাগ তাকেও দেওয়া হবে। আর সুযোগ পেলে সে পালিয়েও আসতে পারবে।

পুলিশ জানিয়েছে, মেহফিজার পরামর্শ মতো টাকার বিনিময়ে ‘বিয়ে’ করা, আর কয়েকদিন সংসার করে ফের পালিয়ে আসাটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল ট্যাঙ্কি। মোট তিন বার এই ভাবে বিয়ে করে উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায় চলে গিয়েছিল ট্যাঙ্কি। বর জোগাড়ের দায়িত্ব ছিল মেহফিজার। এই সব করে যে টাকা পাওয়া যেত, তা ভাগাভাগি হত মেহফিজা ও ট্যাঙ্কির মধ্যে। মাস তিনেক হল সে নিজে আর বিয়ের খেলায় মাতেনি। বদলে মেহফিজার হয়ে নাবালিকার সন্ধান করতে শুরু করল ট্যাঙ্কি। সে ভাবেই তার যোগাযোগ হয় সাঁকরাইলের ওই কিশোরীর সঙ্গে। ওই কিশোরীর বাবা ধুলাগড়ির হাটে মজুরের কাজ করেন। তার মা বাবার সঙ্গে থাকেন না। সেই সুযোগটাই নিয়েছিল ট্যাঙ্কি। সে থাকত ওই কিশোরীর বাড়ির পাশেই। জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, ট্যাঙ্কি বোঝায়, ‘তার বিয়ে দেওয়া হবে। সুখে থাকবে। তবে বাবাকে কিছু বলা চলবে না। ট্যাঙ্কির টোপ গিলতে দেরি হয়নি ওই নাবালিকার।’

পুলিশ তদন্তে জানতে পেরেছে, টোপ দিয়ে কিশোরীদের নিয়ে গেলেই মেহফিজা বা ট্যাঙ্কিদের চিন্তা দূর হত না। কারণ, ভিন্‌ রাজ্যে গিয়ে কোনও কিশোরী যদি শেষ মুহূর্তে গোলমাল বাধায়, তা হলে টাকা পেতে সমস্যা হবে তাদেরই। সেই সমস্যা যাতে না হয়, সে জন্য যোগ্য সঙ্গ দিত পাপ্পু। উদ্ধার হওয়া কিশোরী পুলিশকে জানিয়েছে, প্রথমে সে ট্যাঙ্কির কথায় রাজি হচ্ছিল না। তখন ট্যাঙ্কি তাকে নিয়ে যায় দিঘার এখটি হোটেলে। সঙ্গে পাপ্পুও ছিল। ‘হবু’ স্বামীর যোগ্য করে তুলতে ট্যাঙ্কির পরামর্শে পাপ্পু তার ‘মগজ’ ধোলাই করে। এখানেই শেষ নয়। সে তাকে ধর্ষণও করে। তারপরে সে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। এই ভাবে কেল্লা ফতে হয়ে যাওয়ার পরে, সেখান থেকেই তাকে পাপ্পু ও ট্যাঙ্কি সোজা নিয়ে যায় হাওড়া স্টেশনে। সেখানে আগে থেকে হাজির ছিল মেহফিজা। সেখান থেকে মেহফিজারা কালকা মেল ধরে দিল্লি চলে যায়।

তাদের সঙ্গে পাপ্পু যেত না। তার কাজ শুধু নাবালিকাদের কনের মতো করে গড়ে তুলে স্থানীয় স্টেশনে স্ত্রী ও নাবালিকাকে পৌঁছে দিতেই ফিরে আসত সে। ফিরেই সে আবার সে পুরনো ব্যবসা অর্থাৎ মাংস বিক্রি শুরু করে দিত। যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে। যেমনটা একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেছিল মেহফিজা। বেসরকারি ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার হয়ে গ্রামের গরিব মহিলাদের ঋণ দেওয়ার কাজ করত সে। ঋণদানের কাজে তাকে সাহায্য করত কাশ্মীরা বেগম, সায়েরুন আনসারি, নুরজাহান বেগম, আব্দুল গফফুর কুরেশি এবং শেখ নাসিরের মতো মহিলা- পুরুষেরা। কিন্তু এটা আসলে আড়াল!

কিশোরী নিখোঁজের ঘটনার তদন্তে সাঁকরাইল থানার সাব ইনস্পেক্টর পলাশ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ দল তৈরি হয়। তারাই তদন্তে নেমে ১৬ অগস্ট গ্রেফতার করে মেহফিজা, ট্যাঙ্কি-সহ সাত জনকে। ২৪ অগস্ট মথুরা থেকে উদ্ধার হয় সাঁকরাইলের ওই নাবালিকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

police rape Accused
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE