Advertisement
E-Paper

চেয়ারম্যানের চিঠিতেও নড়ল না পুলিশ

ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেও বিস্ময় কাটছিল না বন্দরের পদস্থ কর্তাদের। নিজেদের জমি দখল করতে গিয়ে দেড় দশকে বহু বাধা এসেছে। কিন্তু জমি দখল করে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষী রেখে আসার পরেও যে এ ভাবে তা হাতছাড়া হবে, তা ভাবতেই পারছিলেন না তাঁরা।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:২৯
তিন অভিযুক্ত।

তিন অভিযুক্ত।

ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেও বিস্ময় কাটছিল না বন্দরের পদস্থ কর্তাদের। নিজেদের জমি দখল করতে গিয়ে দেড় দশকে বহু বাধা এসেছে। কিন্তু জমি দখল করে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষী রেখে আসার পরেও যে এ ভাবে তা হাতছাড়া হবে, তা ভাবতেই পারছিলেন না তাঁরা। বন্দরের এস্টেট ম্যানেজার শুভ্রকমল ধরের কথায়, ‘‘জমির দখল নেওয়ার আগে থানায় গিয়ে সাহায্য চাওয়া হয়। পুলিশ আমাদের সঙ্গে না আসায় নিজেরাই জমির দখল নিই। সে কথাও তারাতলা থানায় জানিয়ে আসি। কিন্তু তা-ও ওই জমি পুনর্দখল করা হল এবং পুলিশ নিষ্কর্মা রইল!। সাংবাদিকেরাও রেহাই পেলেন না।’’

অথচ আগেও পুলিশকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। লাভ হয়নি। এমনকী গত জুলাই মাসে বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ নিজেও কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, বেআইনি ভাবে বন্দরের জমি দখল করে রেখেছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস। আইন-শৃঙ্খলার বিঘ্ন না ঘটিয়ে যাতে বন্দর কর্তৃপক্ষ তার জমির দখল নিতে পারে, সে ব্যাপারে পুলিশ সাহায্য করুক।

কিন্তু তা হয়নি!

এক বা দু’বার নয়। গত জুন মাস থেকে নিজেদের জমি উদ্ধারে একাধিক বার পুলিশি সাহায্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন বন্দর-কর্তারা। কখনও ইদ, কখনও ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের কথা বলে জমি উদ্ধারের কাজে সাহায্য দেওয়া থেকে পিছিয়ে গিয়েছে কলকাতা পুলিশ!

এমন মনোভাব দেখে শেষ পর্যন্ত কলকাতা পুলিশকে সক্রিয় করতে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় বন্দর। তাতেও অবস্থা বদলায়নি। এর মধ্যেই রবিবার নিজেদের নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে বেদখল জমি কব্জায় নিতে যান বন্দর-কর্তারা। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট্রের এস্টেট ম্যানেজার শুভ্রকমল ধরের কথায়, ‘‘বিচিত্র অভি়জ্ঞতা হল! বন্দরের জমির দখল নিতে ১৫০-২০০ জন পাঁচিল টপকালো, তা-ও পুলিশ কিছু করল না! বন্দরের ইতিহাসে এই ঘটনা বিরল।’’

তবে শুধু এই ঘটনা নয়, পি-৫১ প্লটের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে এ রকম নানা অদ্ভুত তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

বন্দর সূত্রের খবর, ১৯৬৯ সালে এই ঠিকানায় প্রায় ১৮৫ কাঠা জমি অ্যাভারি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড নামে ওজনযন্ত্র নির্মাতা একটি সংস্থাকে দেয় কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট। বার্ষিক ভাড়ার চুক্তিতে ৩০ বছরের লিজে এই জমি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে অ্যাভারির লিজ চুক্তি শেষ হয়ে যায়। এর পর বন্দর সেই জমির দখল নিতে গিয়ে দেখে ওই ঠিকানায় অন্তত চার-পাঁচটি সংস্থা নানা স্থায়ী কাঠামো বানিয়ে ফেলেছে! বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, এই কাজ বেআইনি। কারণ, বন্দরের থেকে লিজ নিয়ে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা অন্য কাউকে তা ভাড়া দিলে বন্দরের আগাম অনুমতি প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। ফলে জমির দখল নিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০০০ সালে ‘দ্য পাবলিক প্রেমিসেস (এভিকশন অব আনঅথরাইজড অকুপ্যান্টস), ১৯৭১’ আইনে এস্টেট অফিসারের আদালতে মামলা করে।

বন্দর কর্তারা জানান, ওই মামলার সময়ে অ্যাভারির হয়ে আদালতে হাজির হয় এলএমজে কনস্ট্রাকশন নামে একটি সংস্থা। তারা আদালতে দাবি করে, অ্যাভারির হয়ে ওই জমির রক্ষণাবেক্ষণ তারাই করছে। সুতরাং বন্দর তাদেরকেই এই জমির লিজ নবীকরণ করে দিক। ১১ বছরের মামলা শেষে ২০১১ সালের ৭ মার্চ কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের এস্টেট অফিসারের এজলাস ওই জমি থেকে সমস্ত জবরদখলকারীকে সরিয়ে বন্দরকে তা দখল নিতে বলে।

বন্দরের জমি সংক্রান্ত বিভাগের এক কর্তা জানান, ২০১২ সালের জুন মাস নাগাদ জমিটি দখল করার জন্য যখন পুরো প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, তখন খবর পাওয়া যায়, সেখানে নতুন করে বেআইনি নির্মাণ শুরু হয়েছে। জমি বিভাগের কর্তারা গিয়ে দেখেন, শেডগুলিতে স্টুডিও তৈরির কাজ চলছে। তাঁদের বক্তব্য, দেখা যায়, ১৮৫ কাঠা জমির মধ্যে প্রায় ১০০ কাঠা দখলে নিয়েছে ভেঙ্কটেশ ফিল্মস!

সাংবাদিক বৈঠকে গোটা ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন
পোর্ট ট্রাস্টের আধিকারিক শুভ্রকমল ধর।

বন্দরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, এর পর কয়েক বার চেষ্টা করা হলেও প্রধানত পুলিশি অসহযোগিতার কারণে হাইড রোডের ওই জমি থেকে ভেঙ্কটেশের স্টুডিওগুলিকে সরিয়ে জমির দখল নেওয়া যায়নি। প্রায় ১০০ কাঠা জমিতে বেআইনি ভাবে তারা ব্যবসা চালাচ্ছে। এর জন্য বন্দর এক পয়সাও পায় না। ২০১৩ সালের ১০ জুলাই বন্দর-কর্তারা ওই জমি দখল করতে যান। কিন্তু বেআইনি দখলদারদের বাধার মুখে ফিরে আসতে হয় তাঁদের। অভিযোগ, পুলিশ সে বারও বন্দরকে সাহায্য করেনি। এর পরে ফের এস্টেট অফিসারের এজলাসে মামলা করে বন্দর। ২০১৩-এর ২৬ অগস্ট এস্টেট অফিসার এক রায়ে জানান, হাইড রোডের জমি থেকে সমস্ত বেআইনি দখলদারদের সরিয়ে দিয়ে বন্দরের হাতে তা ফেরানোর জন্য পুলিশি সহায়তা প্রয়োজন। সেই কারণে পুলিশ এই কাজে বন্দরের অফিসারদের সাহায্য করুক। কিন্তু তার পরেও সেই জমির দখল নিতে পারেনি বন্দর।

এ দিন এক বন্দর-কর্তা জানান, জমি উদ্ধারে স্থানীয় পুলিশকে অন্তত আধ ডজন চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারাতলা থানার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনাও হয়। পুলিশ কমিশনারের হস্তক্ষেপ চাওয়ার পর তিন বার উচ্ছেদের চূড়ান্ত দিনক্ষণও জানায় তারা। শেষ বার, গত ৮ অগস্ট জমি দখলের দিন ঠিক হয়। কিন্তু এ বারও পুলিশ জানায়, স্বাধীনতা দিবসের পর্ব না মিটলে পুলিশ পাঠানো সম্ভব হবে না। তার পরেই বন্দর কর্তৃপক্ষ কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে পুলিশের সাহায্য চান। মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ায় এ বার নিজেরাই সেই জমির দখল নিতে গিয়েছিলেন।

শুভ্রকমল ধর বলেন, ‘‘জমির দখল নেওয়ার আগে থানায় গিয়ে সাহায্য চাওয়া হয়। পুলিশ আমাদের সঙ্গে না আসায় আমরা নিজেরাই জমির দখল নিই। সে কথাও তারাতলা থানায় জানিয়ে আসি। কিন্তু তার পরেও ওই জমি পুনর্দখল করা হল এবং পুলিশ নিষ্কর্মা রইল!। সাংবাদিকেরাও রেহাই পেলেন না।’’

এখন কী করবে বন্দর?

বন্দরের চেয়ারম্যান রাজপাল সিংহ কাহালোঁ বলেন, ‘‘আইন মেনে জমি নিতে গিয়েছিলাম। ওরা পুনর্দখল করেছে। যা ঘটেছে, জাহাজমন্ত্রীকে জানিয়ে রেখেছি।’’ বন্দরের এস্টেট ম্যানেজার জানিয়েছেন, এত দিন এই বিষয়ে দেওয়ানি মামলা চলছিল। কিন্তু এ বার ফৌজদারি মামলা শুরু করবেন তাঁরা। জবরদখল, জোর করে তাদের এলাকায় ঢুকে পড়া-সহ একাধিক অভিযোগ তুলে অ্যাভারি ও ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের বিরুদ্ধে এফআইআর-ও করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশের এখনও সুযোগ আছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার।’’

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক ও নিজস্ব চিত্র।

kolkata port trust port trust chaiman police bandar area kolkata port trust land venkatesh films illegal occupation venkatesh films vs kolkata port trust
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy