হেলমেট পরে বেরিয়েছেন সরকারি বাসের চালক। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
এক দিকে ধর্মঘট সফল করতে মরিয়া বিরোধী পক্ষ। অন্য দিকে, চার বছরের শাসনকালে এই প্রথম একজোট হওয়া বিরোধীদের ডাকা ধর্মঘট রুখতে সর্বশক্তি নিয়ে ময়দানে শাসক দল। ফলে বৃহস্পতিবারের ধর্মঘটকে ঘিরে সংঘাতের আবহটা তৈরি ছিলই। তাতে বাড়তি উপাদান যোগ করল পুলিশের অতিসক্রিয়তা। যার জেরে ফতোয়া মেনে সরকারি কর্মীরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হলেও যাঁদের সেই দায় ছিল না, তাঁরা কিন্তু ঘরবন্দিই রইলেন। পুলিশ এবং শাসক দলের দাপাদাপিই তাঁদের আরও বেশি করে কর্মবিমুখ করে দিল!
মঙ্গলবার পুরসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরে আত্মবিশ্বাসী মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী দলগুলির দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ধর্মঘট রুখতে তাঁর প্রশাসন কোমর বেঁধে নামবে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে কর্মী নামিয়ে ধর্মঘট ব্যর্থ করার চেষ্টা আগেও হয়েছে। কিন্তু পুলিশও শাসক দলের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে পথে নেমেছে, এমনটা আগে ঘটেনি। এ দিন ধর্মঘট সফল করতে পথে নামা বিরোধীদের উপরে তৃণমূল কর্মীদের মতোই সমান মারমুখী ছিল পুলিশ। কিন্তু তাতে ফল হয়েছে উল্টো। সংঘাতের আবহে বাড়ি থেকে বেরনোর কথা ভাবেনইনি বেশির ভাগ রাজ্যবাসী।
ধর্মঘট সফল করার ‘অন্য’ হাতছানি অবশ্য আগে থাকতেই ছিল। আজ, শুক্রবার মে দিবসের ছুটি। শনি ও রবি মেলালে পরপর তিন দিনের ছুটি। তার ঠিক আগের দিন ডাকা ধর্মঘটের জেরে পড়ে পাওয়া ছুটি হাতছাড়া করার কারণ খুঁজে পাননি কর্মবিমুখ বহু বাঙালিই। যাঁরা দীর্ঘ সপ্তাহান্তের ছুটির প্রলোভন উপেক্ষা করার কথা ভেবেছিলেন, তাঁদেরও অবশ্য যুক্তি, ‘‘জেনেশুনে কেন বিপদ ডেকে আনব? তার থেকে বাড়িতে বসে থাকাই ভাল।’’
এই ভাবনার পিছনে একটা কারণ যদি হয় শাসক দলের কর্মীদের উগ্র মূর্তি, অন্য কারণ তা হলে অবশ্যই পুলিশের অতি-সক্রিয়তা। পুরভোটে শাসক দলের সন্ত্রাস না-রুখে পুলিশের উদাসীন থাকা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। বিতর্ক তৈরি হয়েছিল ফল বেরনোর পরে শাসক দলের জয়ী প্রার্থীর থানার ওসি-কে জড়িয়ে ধরা নিয়েও। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে গেল ধর্মঘট বিরোধিতায় পুলিশের ভূমিকা! গত দু’দিন ধরে পাড়ায় পাড়ায় রীতিমতো মাইক ফুঁকে তারা প্রচার করেছিল, ‘‘ধর্মঘটে ভয় পাবেন না, দোকান খোলা রাখুন।’’
শুধু প্রচার করেই ক্ষান্ত দেওয়া নয়, এ দিন সকাল থেকে শাসক দলের কর্মীদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে ধর্মঘট ব্যর্থ করতে পথে নামল পুলিশ! বন্ধ দোকান-বাজার খুলতে বলার পাশাপাশি বহু ক্ষেত্রে স্কুলে ঢুকে কর্মীদের হাজিরাও গুনতি করেছে তারা! উল্টোডাঙায় এক শিক্ষক জানিয়েছেন, সকাল থেকে পুলিশ দফায় দফায় এসে স্কুলে ঠিকমতো হাজিরা হয়েছে কি না, দেখে গিয়েছে। শেষ বার হাজিরার তালিকাও তৈরি করে নিয়ে গিয়েছে!
লন্ডভন্ড। কসবার যোগেন্দ্র গার্ডেনের সিপিএম অফিসে ভাঙচুরে অভিযোগ
উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
আর ধর্মঘটের বিরোধিতায় তৃণমূল কর্মীদের ‘দাদাগিরি’ পুলিশ দেখেও দেখতে চায়নি বলে অভিযোগ। বিভিন্ন জায়গায় শাসক দলের বাইক বাহিনী হুমকি দিয়ে স্কুল, কলেজ, দোকান-বাজার খুলতে বাধ্য করলেও তারা চুপ করেই থেকেছে! জলপাইগুড়ি, কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, আসানসোল, জামুরিয়া, কলকাতার যাদবপুরে তৃণমূল সমর্থকরা পুলিশের সামনেই সিপিএমের উপরে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ। বিরোধীদের দাবি, দুই মেদিনীপুরে পুলিশের সামনেই ধর্মঘটীদের মিছিলে তাণ্ডব চালিয়েছে তৃণমূল কর্মীরা। পরে কয়েক জনকে গ্রেফতার করা হলেও তাঁরা সকলেই বিরোধী দলের নেতা-কর্মী! রাজ্যের প্রায় সব জেলাতেই এক চিত্র। অভিযোগ, কোথাও অবরোধ তুলতে, কোথাও বা মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে হাতে হাত মিলিয়ে বিরোধীদের উপরে চড়াও হয়েছে পুলিশ ও তৃণমূল কর্মীরা।
রাজ্যে সাধারণ ধর্মঘটে রেল অবরোধ প্রতিহত করতে এত দিন সক্রিয় হতে দেখা যেত কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী আরপিএফ-কে। বড় কোনও ঘটনা ঘটলে সঙ্গে নামত রাজ্য সরকারের বাহিনী জিআরপি এবং আরও পরে রাজ্য পুলিশ। এ বার রাজ্য প্রশাসনের নির্দেশ ছিল, রেল আটকানোর খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সক্রিয় হতে হবে স্থানীয় পুলিশকে। সেই নির্দেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে মেনেছে। উত্তর ২৪ পরগনার শিয়ালদহ-বনগাঁ শাখার ঠাকুরনগর হোক বা বারাসত-বসিরহাট শাখার ভেবলা— অবরোধ শুরু হতেই পৌঁছে গিয়েছে পুলিশ।
বিরোধীদের প্রশ্ন, সদ্যসমাপ্ত পুরভোটে যে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল, সেই পুলিশই কেন ধর্মঘট ব্যর্থ করতে এত মরিয়া হল? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা যা করেছি, তা শহর ও নাগরিকদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই করেছি।’’ আর তৃণমূলের মহাসচিব তথা শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘প্রশাসনের কাজ প্রশাসন করেছে। পুলিশ তো প্রশাসনেরই অঙ্গ।’’ রাজ্য প্রশাসনের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের নির্দেশেই এ বার নজিরবিহীন সক্রিয়তা দেখিয়েছে পুলিশ। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, ‘‘সরকারের একেবারে শীর্ষ মহল থেকে ধর্মঘট মোকাবিলায় অনেক বেশি কড়া হওয়ার নির্দেশ ছিল। সরকারি অফিস ও স্কুল-কলেজে হাজিরার বিষয়টিও অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়েছে।’’
পুলিশের এই অতি-সক্রিয়তার বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন বাম-বিজেপি-সহ বিরোধী দলের নেতারা। বামফ্রন্টের তরফে মৌলালির মোড় থেকে মল্লিকবাজার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছে— ‘পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়ো, তৃণমূলের ঝান্ডা ধরো’! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘সরকার, প্রশাসন ও শাসক দলের যৌথ আক্রমণ মোকাবিলা করেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ধর্মঘটে সাড়া দিয়েছেন। তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।’’ ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করেছিলেন, এই তথ্য দিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘‘২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল তৃণমূল সরকারও আত্মহত্যার কাজ করল। মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন, পুলিশের ভয়ে মানুষ দোকানপাট খুলবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের অভিযোগ, ‘‘পুলিশ পুরোপুরি তৃণমূলের কর্মী বাহিনীর মতো কাজ করছে। শুধু তৃণমূলের ঝান্ডা ধরে মিছিলে যোগ দেওয়াটা ওদের বাকি আছে!’’
পুলিশের পাশাপাশি রাজ্য জুড়ে শাসক দলের বাহিনীর দাপটও ছিল সকাল থেকেই। ধর্মঘট ভাঙার নামে এ দিন যে ভাবে বাম ও বিজেপির কর্মী-সমর্থকদের মারধর করা হয়েছে, সাম্প্রতিক কালে তেমনটা দেখা যায়নি। কোথাও বিরোধীদের মিছিলে হামলা, কোথাও বিরোধীদের দলীয় কার্যালয়ে চড়াও হয়ে ভাঙচুর, কোথাও আবার থানার সামনেই বেধড়ক পেটানো হয়েছে ধর্মঘট সমর্থকদের। যদিও এত সবের পরে তৃণমূলেরই একাংশের বক্তব্য, ‘‘ধর্মঘট ব্যর্থ করতে গিয়ে আদপে সেটা সফল করার কাজটাই করে দিয়েছি আমরা!’’
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হাওড়া। হাওড়া শহর ও শহরতলি মিলিয়ে প্রায় ২১টি বাস ও একাধিক বাসগুমটি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ১৮টি বাস ভাঙচুরের অভিযোগই উঠেছে শাসক দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে! পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, প্রথম ঘটনাটি ঘটে লিলুয়া থানা এলাকার কোনা বাসস্ট্যান্ডে। অভিযোগ, বেলা ১১টা নাগাদ একদল তৃণমূল কর্মী বাস না-চালানোর জন্য সেখানে ঢুকে ১০টি মিনিবাস ও ২টি ৫৭এ রুটের বাসে ভাঙচুর চালায়। পরের ঘটনাটি বাঁকড়ায়। অভিযোগ, বাস না-চালানোর ‘অপরাধে’ স্ট্যান্ডে ঢুকে শাসক দলের কর্মীরা ৬টি মিনিবাস ভাঙচুর করে। যদিও অভিযোগ উড়িয়ে হাওড়া তৃণমূল জেলা সভাপতি (শহর) তথা রাজ্যের কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, ‘‘তৃণমূল কেন ভাঙচুর করবে? বাস না-পাওয়ায় এলাকার লোকজনই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়ে বাস ভাঙচুর করেছেন।’’ হাওড়ায় ধর্মঘটীরা ২টি সরকারি ও ১টি বেসরকারি বাস ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ।
ধর্মঘট ভাঙতে সরকারের আশ্বাস ছিল, রাস্তায় পর্যাপ্ত যানবাহন থাকবে। বেসরকারি বাস, মিনিবাস, ট্যাক্সি ও অটো ইউনিয়নগুলির সঙ্গে এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকও করেছিলেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু বাস্তবে সকাল থেকে সরকারি বাসের দেখা মিললেও বেসরকারি বাস-মিনিবাস ছিল হাতেগোনা। শিয়ালদহ-হাওড়া স্টেশন এবং বিমানবন্দরে ট্যাক্সিও কার্যত ছিল না। রেল ও মেট্রো চালু থাকলেও ভিড় ছিল খুবই কম। শাসক দলের ইউনিয়নের চাপে কোথাও কোথাও অটো বের হলেও বেলা যত গড়িয়েছে, ততই সংখ্যা কমেছে তাদের।
মুখ্যমন্ত্রীর অবশ্য দাবি, ধর্মঘট পুরোপুরি ব্যর্থ। তার কথায় ‘‘সরকারি অফিসে ৯৮-৯৯ শতাংশ হাজিরা ছিল। কলকারখানাও খোলা ছিল। যাঁরা অফিস করেছেন, তাঁদের অভিনন্দন। যাঁরা করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারই আইনত ব্যবস্থা নেবে।’’ সরকারি সূত্রের খবর, শীর্ষ মহলের কড়া নির্দেশ আর শাসক দলের ইউনিয়নের নেতাদের চোখরাঙানিতে এ দিন সরকারি অফিসে উপস্থিতির হার ছিল মোটের উপর ভালই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা ৮০% ছাড়িয়ে গিয়েছে। বেশির ভাগ সরকারি কর্মীই বুধবার রাত থেকে অফিসে কাটিয়ে বৃহস্পতিবার হাজিরা খাতায় সই করেছেন। ব্যস ওইটুকুই! হাজিরা খাতায় সই করে বেলা ১টার পর থেকেই অফিস ছাড়ার হিড়িক পড়ে যায়! ধর্মঘট ব্যর্থ দাবি করার পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলায় আর কর্মনাশা বন্ধ হবে না, কর্মেঠাসা বাংলা হবে।’’ যা শুনে এক বিরোধী নেতার তির্যক মন্তব্য, ‘‘১৯৯৮ সাল থেকে উনি কতগুলো বন্ধ ডেকেছেন, সে হিসেবটা কি ওঁর মনে আছে?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy