যেন নদীর এ পার-ও পারের দীর্ঘশ্বাসের কাহিনি। বছর দশেক আগের শিক্ষকদের প্যানেল বাতিল হওয়া রাজ্যে চাকরির খোঁজে এলেন ভিন্ রাজ্যের অনেকে। এ রাজ্যে কাজ না থাকায়, পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে ভিন্ রাজ্যে যাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ— বার বার অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। রবিবার ভিন্ রাজ্য থেকে, বিশেষত, বিজেপি শাসিত রাজ্য থেকে অনেকের এ রাজ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) পরীক্ষা দিতে আসার ঘটনাকে হাতিয়ার করে তৃণমূলের পাল্টা দাবি, ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের রাজ্যে কর্মসংস্থানের হাল এ প্রবণতা থেকেই স্পষ্ট। বিরোধীদের পাল্টা টিপ্পনী, এখানে টাকা দিলে চাকরি হয়, সে খবর পেয়েই হয়তো কেউ-কেউ এসেছেন।
এসএসসি জানিয়েছে, মোট পরীক্ষার্থীর প্রায় দশ শতাংশ এসেছিলেন ভিন্ রাজ্য থেকে। অর্থাৎ, প্রায় ৩১ হাজার। কলকাতা, শিলিগুড়ি, পুরুলিয়া, আসানসোলের নানা কেন্দ্রে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড থেকে আসা পরীক্ষার্থীদের দেখা মিলেছে।
উত্তরপ্রদেশের চিত্রকূটের বাসিন্দা দীনেশ সিংহ কলকাতায় বলেন, ‘‘কিসের ডবল ইঞ্জিন! শূন্যপদ থাকলেও দশ বছর পরে পরীক্ষা হয়। তার পরে আবার প্রশ্ন ফাঁস হলে তারিখ পিছোয়। ২০২১-এ ফর্ম ভরেছি, আর কোনও সাড়া নেই। আমার মতো যুবকেরা বিহার, রাজস্থান, বাংলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’’ প্রয়াগরাজের সতীশকুমার পাল জানান, এমএসসি-বিএড করেও চাকরি পাননি। জৌনপুরের রাজকুমার যাদবের দাবি, পিএইচ ডি করেও কর্মহীন রয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, নিজেদের রাজ্যে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়াও খুব শ্লথ। নিরুপায় হয়ে ভিন্ রাজ্যে ছুটছেন। দিল্লির মহেশ্বরী শুক্লের আবার দাবি, ‘‘নিয়োগে দুর্নীতি সব রাজ্যে হয়। ভুক্তভোগী পরীক্ষার্থীরা। এখানে ওএমআর শিটের কার্বন কপি আমাদের দিয়ে দেওয়ায় খুশি হয়েছি।’’
ভিন্ রাজ্যে যখন বাঙালি-হেনস্থার অভিযোগ উঠছে, তখন বাংলায় এসে পরীক্ষা দিতে কোনও আশঙ্কা কাজ করছে না? প্রয়াগরাজ থেকে পুরুলিয়ায় আসা সচিন তিওয়ারির জবাব, ‘‘বাংলা বলায় নানা জায়গায় সমস্যা হচ্ছে শুনেছি। তবে হিন্দিতে কথা বলা নিয়ে এখানে কোনও সমস্যা হয়নি।’’ সচিনের মতো অনেকেই জানান, মূলত হিন্দি ভাষা পড়ানোর জন্য পরীক্ষায় বসেছেন। এ রাজ্যে চাকরি পেলেও ভাষা-সমস্যা হবে না, আশাবাদী তাঁরা। উত্তরপ্রদেশ থেকে শিলিগুড়িতে পরীক্ষা দিতে আসা অর্পিত যাদব, কুলদীপ কুমারদেরও বক্তব্য, ‘‘এখানে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ।’’
বিধানসভায় বিজেপির পরিষদীয় দলের সচেতক শঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘চাকরিপ্রার্থীরা বিভিন্ন রাজ্যে পরীক্ষা দেবেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে এখানে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়া যায়, এমন নিশ্চয়তাও ভিন্ রাজ্য থেকে আসায় ইন্ধন জুগিয়েছে কি না, তা ভবিষ্যতে প্রমাণ হবে।” সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীরও বক্তব্য, “বাংলা বা যোগী-রাজ্য, কোথাও নিয়োগ নেই। ভিন্ রাজ্যের পরীক্ষার্থীরা বোধ হয় খবর পেয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে টাকা দিলে কিছু একটা হবে। তা না হলে, আচমকা কেন এমনটা হবে?’’ তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষের পাল্টা বক্তব্য, “ডবল ইঞ্জিন সরকারগুলির কর্মপ্রার্থীরা অনেকেই বলছেন, ওখানে চাকরি নেই, ঠিক মতো পরীক্ষা হয় না। তাই তাঁরা এখানে পরীক্ষা দিতে এসেছেন। এখানে কেউ বলেননি, বাংলার চাকরির পরীক্ষা শুধু বঙ্গবাসীই দিতে পারবেন। কেউ হয়রান, অপমান করেননি। বাধাও দেননি।”
এরই মধ্যে, উত্তরপ্রদেশের রামপুরের গোপীগঞ্জের আনন্দকুমার বিন্দের অভিযোগ, পরীক্ষা দিতে শনিবার ট্রেনে হুগলি স্টেশনে পৌঁছে এক জনের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর সঙ্গে খাওয়া সেরে গঙ্গাস্নানে যান। আর কিছু মনে নেই তাঁর। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরতে দেখেন, মোবাইল, টাকা সব খুইয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিতে পেরেছেন তিনি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)