রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আবহে হঠাৎ মধ্য কলকাতার তৃণমূল নেতা প্রদীপ ঘোষের ছেলে সজল ঘোষ ‘বেসুরো’। বুধবার রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্ট করেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি সজল। সেই পোস্টের ছত্রে ছত্রে রয়েছে দলের প্রতি তাঁর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। বিশেষত, ‘ভুল’, ‘মিরজাফর’, ‘রাজনীতিতে পাকা জায়গা’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের চয়ন এবং ‘সুপরিকল্পিত’ প্রয়োগ টের পাইয়ে দিচ্ছে তাঁর ক্ষোভের মাত্রা। ‘সারদা’, ‘নারদ’-এর মতো বিতর্কের কথা টেনে এনে নিজের ‘উপলব্ধি’র কথাও তুলে ধরেছেন সজল। এই ‘ঘূর্ণন’-এর ভিতর থেকে উঠে আসছে প্রদীপ-পুত্রের দলবদলের সম্ভাবনার কথাও।
নেটমাধ্যমে সজল লিখেছেন, ‘ভুল করেছিলাম। ছোটবেলায় কলেজে পড়তে গিয়ে এসএফআই এবং সিপিএমের সঙ্গে যে লড়াই করেছিলাম সেটা পুরোপুরি ভুল ছিল। আজও কমপক্ষে ২৫টি মামলা আমার মাথার উপর ঝুলে। না, না, সেগুলি তোলাবাজি বা সারদা-নারদ মামলা নয়। কলেজে ভর্তির বিনিময়ে টাকা নেওয়ার মামলাও নয়। আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ছিল ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে, এসএফআই-এর মাধ্যমে তা সিপিএম যে ভাবে হরণ করে নিয়েছিল, তার বিরুদ্ধে। ওরা (এসএফআই/সিপিএম) যে ভাষায় কথা বলত, আমরাও সেই ভাষায় উত্তর দিতাম। সেটাই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’। সজল যে সময় নেটমাধ্যমে নিজের ‘উপলব্ধি’র কথা তুলে ধরেছেন তার কিছু ঘণ্টা পরেই ঘটনাচক্রে রাজ্যে নয়া শিল্প স্থাপন, বেকারত্ব-সহ একাধিক ইস্যুতে নবান্ন অভিযান করে বাম যুব সংগঠনগুলি।
চলচ্চিত্র এবং ধারাবাহিক জগতের একাধিক কলাকুশলীরা এখন শাসকদলের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে। সেই প্রসঙ্গ টেনে আক্ষেপের সুর সজল লেখনিতে, ‘নিদেনপক্ষে যদি একটু চেষ্টা চরিত্র করে টিভি সিরিয়ালের ফোর্থ গ্রেডের আর্টিস্ট হতে পারতাম, তা হলে বোধহয় আজকের রাজনীতিতে আমাদের জায়গাটা অনেকটা পাকা হত। আর যদি পুরুষ না হয়ে মহিলা হতাম, তা হলে বলতাম নিদেনপক্ষে সুজাতা মণ্ডল খাঁ। রাজনৈতিক দলগুলোতে আজ তো ওদেরই রমরমা’।
দলের মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফেসবুকে ওই প্রাক্তন ছাত্রনেতার বক্তব্য, ‘জানি, আমরা দলে থাকলে বা না থাকলে কিছু যায় আসে না। দলে আজকের অনেক বড় বড় নেতা (বাম জমানায় মানুষ যাদের নামই শোনেননি) তাঁরা জানেনও না, আমরা আদৌ দলে আছি কি না’। সেই ‘যন্ত্রণা’ নিয়েই তিনি লিখছেন, ‘এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে একটা কথা বলতে পারি, আমাদের সঠিক মূল্যায়ন আমার দল আমাদের সাথে করেনি’।
দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে সজলের স্মরণ করেছেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্রের কথাও। তিনি লিখেছেন, ‘জীবনের আসল সময়টা কেটে গিয়েছে পুলিশের তাড়া খেয়ে, সোমেন জেঠুর বাড়ির ওই ১০ ফুট বাই ১০ ফুট ঘরটার মধ্যে গাদাগাদি করে আমরা অনেক ছেলে রাত কাটাতাম। তখন শুলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। কিন্তু আজ নরম বিছানায়, এয়ারকন্ডিশন চালিয়েও ঘুম আসে না। যন্ত্রণা তাড়া করে বেড়ায়। অসম্মানের যন্ত্রণা, অবহেলার যন্ত্রণা’। এর পরেই আক্ষরিক অর্থেই জ্বলে উঠেছেন প্রদীপ-পুত্র। লিখেছেন, ‘কারও কাছে কান্নাকাটি করা বা এ সব লিখে করুণা আদায় করার কোনও মানসিকতা আমার বা আমার মতো যাঁরা আছেন, তাঁদের কারও নেই। তাই বলছি, প্রয়োজনে খেলার মাঠেই দেখা হবে’। এর পরেই তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা, ‘শুধু এইটুকু বলে শেষ করতে চাই, বিশ্বাস করুন সিরাজউদ্দৌলা হতেই মন চায়, কিন্তু তা যদি হতে না দাও, মিরজাফর তোমাকে সেলাম’।
কী কারণে এই ক্ষোভ? আনন্দবাজার ডিজিটালকে সজল বললেন, ‘‘এক সময় আমি তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কার্যকরী সভাপতি ছিলাম। অথচ আজ আমি ওয়ার্ডেরও কেউ না। এটা কোনও অভিমানের কথা নয়। আমি যা লিখেছি, তা বাস্তব। দলে আজ কারা রয়েছে? যাঁরা টিকটকে সারা দিন জামা-কাপড় খুলে সারাদিন নেচে বেড়ায় তাঁরা। তাঁদেরই গুরুত্ব, তাঁদেরই মাহাত্ম্য। মা-মাটি-মানুষের ভাবনা নিয়ে তৃণমূল তৈরি হয়েছিল, প্রকৃত কংগ্রেসিদের সম্মান জানাতে। কিন্তু তাঁরা সামান্য সম্মানটুকুও পাননি।’’
এক সময় তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন প্রদীপ। সেই পথে কি এগোবেন সজলও? তাঁর এমন ‘বিদ্রোহী মেজাজ’ তুলে দিয়েছে শিবির বদলের সম্ভাবনার কথাও। যদিও সেই প্রশ্নের উত্তরে সজলের বার্তা, ‘‘এখনও বলার মতো সময় আসেনি। এলে অবশ্যই নিজের সিদ্ধান্তের কথা নেটমাধ্যমে জানিয়ে দেব।’’
সজলের ফেসবুক পোস্ট এবং বক্তব্য নিয়ে কী বলছে তৃণমূল? প্রদীপ পুত্র যে কোন পথ অনুসরণ করবেন তা নিয়ে প্রায় নিশ্চিত দলের একাংশ। মধ্য কলকাতারই এক তৃণমূল নেতা বলেই দিলেন, ‘‘উনি তো বিজেপির পথে পা বাড়িয়েই রয়েছেন। তাই দল আর ওঁর কথায় গুরুত্ব দেয় না।’’