বিদ্যানগর কলেজে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে খোশমেজাজে ‘ঘরের লোক’ রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। (ডান দিকে) বক্তৃতা শিক্ষামন্ত্রীর। ছবি: প্রদীপ আদক
দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই ‘পাড়াগাঁয়ে’ই পাকাপাকি থেকে যাওয়ার কথা একদা ভেবেছিলেন তিনি। তাই জমি পর্যন্ত কিনে ফেলেছিলেন এলাকার আনকোরা কলেজের মাস্টারমশাই।
সে ইচ্ছে শেষমেশ পূরণ হয়নি। জীবন টেনে নিয়ে গিয়েছে অনেক দূরে, অন্য ঠিকানায়! কিন্তু অধুনা রাইসিনা হিলসের বাসিন্দা প্রণব মুখোপাধ্যায় পাঁচ দশক বাদেও ভোলেননি যৌবনের চারণভূমিকে। বুধবার সকালে কলকাতার ত্রিশ কিলোমিটার দূরের জনপদে এসে দেশের রাষ্ট্রপতি তা-ই দেখিয়ে গেলেন।
আমতলার কাছে বিদ্যানগর কলেজের তিনটি নতুন ভবনের এ দিন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন রাষ্ট্রপতি। শুধু এটুকু বললে কিছুই বলা হবে না। প্রাক্-রাজনৈতিক জীবনে কেন্দ্রীয় সরকারের কেরানিগিরি ছেড়ে এই কলেজেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৩-তে কলেজের প্রথম দিন থেকে শুরু করে কাটিয়েছেন পাঁচ-পাঁচটি বছর। তার পরেও সম্পর্কে চিড় ধরেনি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে পরে, ২০১৩-র জানুয়ারিতে কলেজে এসে প্রণববাবু তিনটি নতুন ভবনের শিলান্যাস করে গিয়েছিলেন।
সেগুলোর পরিপূর্ণ রূপটাই এ দিন দেখলেন রাষ্ট্রপতি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর ১০ কোটি ২৩ লক্ষ টাকার অনুদানে কাজ হয়েছে যথেষ্ট দ্রুততায়। মঞ্চে উপস্থিত ইউজিসি সভাপতি বেদ প্রকাশের প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল রাষ্ট্রপতির কণ্ঠে— ‘‘এই কাজটার পিছনে আমার কমিটমেন্ট (দায়বদ্ধতা) ছিল! উনি (বেদপ্রকাশ) অনেক চেষ্টা করেছেন, যত্ন নিয়েছেন!’’ একদা দেশের প্রথম সারির রাজনীতিবিদ এ-ও বললেন, ‘‘এত বছর রাজনীতি করেছি। এ দেশের আমলাতন্ত্র কী জিনিস, খুব ভাল জানি! আমলাতন্ত্রের লাল ফিতের ফাঁস খোলার জন্য বেদপ্রকাশকে ধন্যবাদ।’’
সে যুগে হাওড়া কদমতলার বাড়ি থেকে প্রণববাবুর বিদ্যানগরে আসাটা ছিল রীতিমতো ‘অভিযান।’ ধর্মতলায় এসে বাস বদলে কোনও
দিন ঠাকুরপুকুর বা মোমিনপুর। তার পরে আমতলার বাস। কিলোমিটার ছয়েক রিকশাতেও যেতে হতো। রাজভবন থেকে এ দিন সেই পথটা অবশ্য গাড়িতেই পেরিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। পরে মঞ্চে আসীন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, স্থানীয় সাংসদ তথা তৃণমূলের ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের সামনে মমতা সরকারকে কার্যত শংসাপত্র দিয়েছেন। ‘‘শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোয় গত সাড়ে চার বছরে বাংলা অনেক উন্নত হয়েছে!’’— পর্যবেক্ষণ রাষ্ট্রপতির।
তবে বর্ষীয়ান রাষ্ট্রনেতা এ দিন যেন বর্তমানের চেয়ে অতীতেই বুঁদ ছিলেন বেশি। বক্তৃতার পরতে-পরতে তারই ছবি। ‘‘তখন কলেজের বাড়ি নেই, ক্লাসরুম নেই। সাত জন শিক্ষক, সত্তর জন ছাত্র। তখন ভাবাই যেত না, ইউজিসি’র চেয়ারম্যান বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এখানে আসবেন!’’— স্মৃতিচারণা রাষ্ট্রপতির। শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছেন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ধীরেন্দ্রনাথ বেরা ও প্রাণপুরুষ শিক্ষাব্রতী হরেন্দ্রনাথ মজুমদারকে। কলেজে প্রণববাবুর পরিচিতদের মুখে শোনা গেল, পরে হরেনবাবু হাসনাবাদে বাংলা কংগ্রেসের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর হয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রণববাবু ক্রমশ রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়দের কথাও উঠে এসেছে তাঁর বক্তৃতায়।
পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রণববাবুর সহকর্মী প্রদ্যোতকুমার মণ্ডলের মুখে শোনা গেল মজার গল্প— কী ভাবে অধ্যক্ষকে ফাঁকি দিয়ে আম খাওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে প্রদ্যোতবাবু বলছিলেন, ‘‘ছাত্রদের দেওয়া এক ঝুড়ি আম ছিল প্রণবদার জিম্মায়। প্রিন্সিপাল এসে খোঁজ নেওয়ায় প্রণবদা বেমালুম বলে দিলেন, সব আম টক! আমরা খুব হেসেছিলাম।’’ প্রসঙ্গত, বিদ্যানগরে জমি কিনে পরে প্রদ্যোতবাবুকেই বিক্রি করে দেন প্রণবববাবু।
তবে রাষ্ট্রপতির একটি আশা এ দিন পূর্ণ হয়নি। কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ (বর্তমানে পরিচালন সমিতির সভাপতি) কার্তিকচন্দ্র অধিকারীর কথায়, ‘‘প্রণবদা বারবার বলেছিলেন, অর্থনীতির রবীন চট্টোপাধ্যায় ও ইংরেজির মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় যেন আসেন। কিন্তু ওঁরা দু’জনেই অসুস্থ।’’ কলেজের সূচনাকালের সাত শিক্ষকের মধ্যে প্রণববাবু ছাড়া ওই দু’জনই এখন রয়েছেন। আর এক প্রাক্তন অধ্যাপক শুভেন্দু বারিক জানালেন, দর্শনের শিক্ষক কিশোরীমোহন ভট্টাচার্যের চলে যাওয়ার খবর তাঁর মুখে শুনে রাষ্ট্রপতি ফোনে কেমন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
সেই বিষাদের রেশ ছুঁয়েই যেন হঠাৎ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় ডুব দিয়েছিলেন প্রণববাবু— ‘প্রাক-পুরাণিক বাল্যবন্ধু যত, বিগত সবাই তুমি অসহায় একা!’ মাঠে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর ভিড়। মঞ্চ ঠাসা আমলা-মন্ত্রীতে। তারই মাঝে খুঁজে পাওয়া গেল নিঃসঙ্গ রাষ্ট্রপতিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy