Advertisement
E-Paper

‘বাইরের’ রোগীর চাপে ফ্রি চিকিৎসার নাভিশ্বাস

দিকে দিকে রটে গিয়েছে বার্তা, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ‘ফ্রি’! তাই ভিন্ রাজ্য, এমনকী প্রতিবেশী দেশ থেকেও দলে-দলে রোগী চলে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে, সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা পেতে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২২

দিকে দিকে রটে গিয়েছে বার্তা, পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ‘ফ্রি’! তাই ভিন্ রাজ্য, এমনকী প্রতিবেশী দেশ থেকেও দলে-দলে রোগী চলে আসছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যে, সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় চিকিৎসা পেতে। এই রোগীদের ভিড় বেশি বাড়ছে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলিতে। এত দিন যাঁদের ভরসা ছিল মূলত কলকাতার কিছু নামী বেসরকারি হাসপাতাল, গত আট-ন’ মাস ধরে তাঁদেরই একটা বড় অংশ আসছেন রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে। ফ্রি-তে দামি ওষুধ পাচ্ছেন তাঁরা। অস্ত্রোপচার ও ডায়ালিসিস করিয়ে যাচ্ছেন। বসিয়ে নিচ্ছেন পেসমেকার।

ফ্রি পরিষেবা চালু হওয়ায় এমনিতেই গত নভেম্বর মাস থেকে সরকারি হাসপাতালে সার্বিক ভাবে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে রাজ্যে। তার উপর ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, সিকিম, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, মায়ানমারের প্রচুর রোগী আসছেন। মূলত ক্যানসার, স্নায়ুরোগ, ডায়ালিসিস ও হৃদ্‌রোগের চিকিৎসা নিখরচায় করাতে। লাগাতার বিপুল পরিমাণ দামি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর খরচ বইতে গিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের নাভিশ্বাস উঠছে। ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ বা কিডনির অসুখে দেড়-দু’লক্ষ টাকার ওষুধও ফ্রি-তে দেওয়া হচ্ছে কোনও কোনও রোগীকে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গত আট মাসে সরকারি হাসপাতালে এই ‘বাইরের’ রোগী গড়ে প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে।

সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলির কর্তৃপক্ষদের একটা বড় অংশ গত মাসে স্বাস্থ্যভবনের দ্বারস্থ হয়ে জানতে চেয়েছেন, এই ভিন্‌দেশি বা ভিন্ রাজ্যের রোগীরাও কি সব রকম ওষুধ ও পরিষেবা ফ্রি-তে পাবেন? এঁদেরও কি বিনামূল্যে পেসমেকার-স্টেন্ট জোগানো হবে? হাসপাতালগুলির কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এটা ঘটনা যে, ফ্রি পরিষেবা চালুর পর রাজ্য সরকার স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বরাদ্দ অনেক বাড়িয়েছে। কিন্তু রোগীর চাপ এতটাই যে তাতেও পুরোটা কুলোচ্ছে না। অন্য রাজ্যের বাসিন্দা ও বিদেশিরা সরকারি হাসপাতালে এ ভাবে আসতে থাকলে পরিষেবা দেওয়াই মাথায় উঠবে, বলে তাঁদের আশঙ্কা।

কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ গত মাসে স্বাস্থ্য দফতরের উচ্চ পর্যায়ের মাল্টি ডিসিপ্লিন্যারি অ্যাকশন গ্রুপের কাছে বিষয়টি তোলেন। এই গ্রুপের অন্যতম সদস্য শান্তনু সেনের কথায়, ‘‘সরকারি ঘোষণায় কোথাও এ কথা বলা নেই যে, ভিন্ রাজ্য বা বিদেশিদের ফ্রি পরিষেবা দেওয়া যাবে না। তাই অ্যাকশন গ্রুপ এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তবে অবিলম্বে সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে ও ইমার্জেন্সি থেকে রোগী ভর্তির সময় ভোটার কার্ড বা আধার কার্ডের প্রতিলিপি জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার কথা ঠিক হয়েছে।’’ কিন্তু তাতে আবার দুর্ঘটনাগ্রস্তদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা।

অ্যাকশন গ্রুপের আর এক সদস্য ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে। আমার ব্যক্তিগত মত, রাজ্যের ব্যবস্থা রাজ্যের লোকের জন্যই হওয়া উচিত। ফ্রি ব্যবস্থার অপব্যবহার আটকাতে হবে। এ রাজ্যে বসবাসের শংসাপত্র (‌রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট) না থাকলে সেই রোগীর পুরো ফ্রি পরিষেবা পাওয়া উচিত নয়।’’

স্বাস্থ্য-শিক্ষা দফতরের এক কর্তার কথায়, খরচেরও তো একটা সীমা থাকে! পেয়িং বেড বন্ধ হওয়ায় সরকারি হাসপাতালের আয়ের পথ বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীর খরচ চার গুণ হয়েছে। অনেক সময়েই অনেক দামি ওষুধ যথেষ্ট পরিমাণে হাসপাতালে থাকছে না। রোগীর চাপে রক্ত পরীক্ষা, ইসিজি থেকে শুরু করে বায়প্‌সি, ডায়ালিসিস, স্ক্যান— যে কোনও কিছুরই ডেট পাওয়া দুরাশা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। জরুরি অস্ত্রোপচারেরও ডেট পাওয়া যাচ্ছে না। মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ সব নিয়ে রোগীরা উত্তেজিত হয়ে উঠছেন। আউটডোরে দামি ওষুধ দেওয়া বা অন্য কিছু ক্ষেত্রে অনেক মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষকে রাশ টানতে হচ্ছে। ভিন্ রাজ্যের ও বিদেশি রোগীরা ভিড় বাড়তে থাকায় করায় পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে আরও।

এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘‘সরকার বলছে সরকারি নার্সিংহোম চালু করে আয়ের পথ করবে, কিন্তু যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে ওই পন্থাতেও বিশেষ কোনও সুরাহা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আগামী দিনে শয্যার আকাল আরও তীব্র হবে।’’

‘বাইরের’ রোগীদের নিয়ে হাসপাতালগুলি কী বলছে?

বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজের এক কর্তা জানালেন, গত আট-ন’ মাসে সেখানে বিহার ও ঝাড়খণ্ড থেকে বহু ক্যানসার রোগী এসেছেন। ওই কর্তার কথায়, ‘‘এই সব রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীরা সব ফোন করে ওই রোগীদের ভর্তি নেওয়ার সুপারিশ করছেন।’’

আরজিকর হাসপাতালের এক কর্তা জানালেন, গত কয়েক মাসে তাঁদের হাসপাতালে বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীর সংখ্যা তিন গুণ হয়েছে। এঁদের ব্যাপারে সরকারের স্পষ্ট নীতি না থাকায় প্রত্যেককেই নিখরচায় পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এক কর্তা আবার জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সচ্ছল পরিবারের লোকেরাও তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে চলে আসছেন মূলত ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘ওই রোগীরা বলছেন, কলকাতার সরকারি হাসপাতালে ভাল ভাল ডাক্তারবাবুরা রয়েছেন। তার উপর ক্যানসারের সব দামি ওষুধ যদি ফ্রি-তে মেলে তা হলে খামোখা কেন বেসরকারি জায়গায় ভর্তি হয়ে লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচা করবেন?’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘এই রোগীদের উপর কিছুটা লাগাম টানতে আমরা দাবি করেছিলাম, স্থানীয় কোনও আত্মীয়ের ‘রেসিডেন্সিয়াল সার্টিফিকেট’ আনতে হবে। কিছু বাংলাদেশি রোগী আবার দালাল ধরে ত-ও জোগাড় করে ফেলছেন।’’

গত মাসে এসএসকেএম হাসপাতালে বাংলাদেশের দু’জনের নিখরচায় পেসমেকার বসেছে। সে দেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ গত পঞ্চমীর দিন এই হাসপাতালে মেডিসিন ও কার্ডিওলজি বিভাগে দেখিয়ে গিয়েছেন। তিনি টেলিফোনে মমতার এই ফ্রি নীতির ভূয়সী প্রশংসা করে সোমবার বলেন, ‘‘খুব ভাল প্রয়াস। এটা হওয়ার পর আমাদের দেশ থেকেও অনেকে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন। তবে আইডেন্টিটি কার্ড নিয়ে একটা বিভ্রান্তি হচ্ছে। কোনও হাসপাতাল ওঁদের চিকিৎসা করছেন, কোথায় আবার বলা হচ্ছে, স্থানীয় কোনও আত্মীয়ের ঠিকানা দিলে তবে চিকিৎসা ফ্রি হবে। একটা পরিষ্কার নীতি থাকলে খুব সুবিধা হয়।’’

এসএসকেএমে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই নেপাল, ভুটান, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা, ওড়িশা মিলিয়ে ১৫ জন রোগীর ক্যানসার, ডায়ালিসিস, স্নায়ুরোগের জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে। এঁদেরই এক জন নেপালের কানহাপুরের গীতা দেবী। ভর্তি হয়েছিলেন গত ২ সেপ্টেম্বর। ওড়িশার বালেশ্বরের সাবিত্রী খিলার ভর্তি হন গত ৬ সেপ্টেম্বর। দু’জনেই বললেন, ‘‘বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির পয়সা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের মমতা দিদির জন্য ফ্রি-তে অপারেশন করতে পেরে বেঁচে গেলাম।’’

‘‘এমনটা শুনতে পেলে অবশ্যই ভাল লাগে। কত দিন এ ভাবে চালানো যাবে সেটাই চিন্তার,’’ বললেন ওই হাসপাতালেরই এক প্রবীণ চিকিৎসক।

free treatment govt hospital
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy