ইতিহাসের সাক্ষ্যবহনকারী ইমামবাড়া সংলগ্ন মেলা প্রাঙ্গণে সার সার দিয়ে রাখা সুসজ্জিত বেশ কয়েকটি তাজিয়া, রঙ বে রঙের নিশান।
চারদিকে বাজনা। কারবালার স্মৃতিতে সম্মিলিত হায় হোসেন ধ্বনি। তাজিয়া রেখে মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন অংশে লাঠির বা তলোয়ার-সহ বিভিন্ন খেলা দেখাতে ব্যস্ত তরুণ যুবার দল। আর হাজার হাজার সুবেশ পুরুষ মহিলাও শিশু।
ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডারে প্রথম, মহরম মাসের ১০ তারিখ বীরভূমের রাজনগরে এটাই ছবি। রাজনগরে মুসলিম রাজাদের শাসনকালে নির্মিত ইমামবাড়াটির সামনে যেন রঙের সমারহ। যা কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসছে। শুধু মুসলিমরা নন রাজনগরের ঐতিহ্যশালী মহরেমের মেলায় সমানভাবে অংশ গ্রহণ করেন হিন্দুরাও। শনিবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দুর্গাপুজোর ঠিক গা ঘেঁষে মহরম পারায় খুশি হিন্দুরাও।
বর্তমানে মহরম মেলাটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকে রাহে ইসলাম মেলা কমিটি। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাহে ইসলামের পাশে থাকে শান্তি কমিটি। সহযোগিতায় থাকে রাজনগর ব্লক ও পুলিশ প্রশাসন। দুটি কমিটির সভাপতি মুসলিম রাজাদের বর্তমান উত্তরপুরুষ রাজা রফিকুল আলম সাহেব। ওঁর হাত ধরেই মেলার সূচনা হল শনিবার সকালে।
রাহে ইসলাম কমিটির সম্পাদক শেখ মন্টু এবং শান্তি কমিটির সম্পাদক সুনীল মণ্ডলরা জানিয়েছেন, ‘‘রাজনগরে সবচেয়ে বড় উৎসবের মধ্যে পড়ে মহরম মেলা। মাত্র এক বেলার এই মেলায় যেহেতু সকলে মেলায় আসেন তার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়। আর রাজনগর, নাকাশ ও গাংমুড়ি জয়পুর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রাম বা পাড়া থেকে যে তাজিয়া বা নিশান বর্ণাঢ্য শাোভাযাত্রা করে মহরম মেলায় আসে তার প্রস্তুতিও চলে বেশ কিছুদিন আগে থেকে। সেই তাজিয়া তৈরির সময় থেকেই।’’
রাফিকুল আলম জানিয়েছেন, ‘‘একদা বীরভূমের রাজধানী রাজনগর। শাসক ছিলেন মুসলিম রাজারা। ১৬০০ সালের পর রণমস্ত খাঁ বা পরবর্তিতে আলিনকি খাঁয়ের আমল থেকেই ঐতিহ্য মণ্ডিত মেলার চল। সেই ধারা এখনও অটুট। মেলায় উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন রাজনগরের বিডিও দীনেশ মিশ্র রাজনগর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুকুমার সাধু। বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে হাজির ছিলেন রাজনগর থানার ওসি সুজয় তুঙ্গা।’’
সকাল আটটা থেকেই তাজিয়া নিয়ে মেলা প্রাঙ্গণে শোভাযাত্রা সহকারে একে একে আসতে শুরু করে রাহে ইসলাম, আড়ালি, সিকির পাড়া, খোদাইবাগ, দামপাড়া, রঞ্জু পাড়া, গুলালগাছির তাজিয়া গুলি। ঘন্টা খানেকের মধ্যে মেলা প্রাঙ্গণে থিকথিকে ভিড়। পসরা নিয়ে উপস্থিত বিভিন্ন স্টল। বাজনার আওয়াজ, মেলাকমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। একসময় রাজপরিবারের তাজিয়ার দায়িত্ব এখন মেলা পরিচালন কমিটিই নিয়েছে। সেই তাজিয়াই সবার আগে থাকে। শিল্প কর্মে সুসজ্জিত সেরা তাজিয়ার জন্য থাকে পুরস্কার।
কালের প্রভাবে ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়েছিল রাজনগরের ইমামবাড়া। বছর দু’য়েক আগে সংস্কার হয়েছে সেটির। দুধ সাদা ইমামবাড়ার সামনে নানা বর্ণের তাজিয়া ও মেলায় চুটিয়ে আনন্দ করলেন রাজনগরের কলেজের ছাত্রী মামনি খাতুন বা পুজোয় রাজনগরের মাসির বাড়িতে বেড়াতে আসা তরুনী রূপলেখা সরকারেরা। বললেন, ‘‘অনেক জায়গায় মহরম দেখেছি কিন্তু রাজনগরের মহরেম সম্পূর্ণ আলাদা।’’
ছোট্ট মেয়ে শিল্পীর জন্য জন্য মেলা থেকে বাঁশি কিনে দিতে দিতে বধূ আল্পনা সাহা কিংবা ছেলে আমিরের জন্য মেলা থেকে ঢোল কিনতে কিনতে মেহরুন্নিসা বেগম জানালেন, ‘‘খুব ভাল লাগে রাজনগরের মহরম। বাড়িতে এই সময় বাইরে থেকে লোকজন আসে।’’
দৃশ্যতই, পুজো শেষে রাজনগরের মহরম পড়ায় উৎসবের যেন আরও একটা দিন বাড়তি পাওনা!’’