লক্ষ্য হারিয়ে যাওয়ার মুখ থেকে ‘সের-পাই’ শিল্পকর্মকে বাঁচানো। আর তার জন্যই বিশেষ কর্মসূচি শুরু করেছে বীরভূম জেলা প্রশাসন।
এমনিতে খয়রাশোল ব্লকের ওই বিশেষ কুটির শিল্পের রাজ্য জোড়া প্রসিদ্ধি রয়েছে। কিন্তু, সেই শিল্প মূলত একটি পরিবারেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিপন্ন ও কুটির শিল্পকে বাঁচাতেই মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্যদের ওই শিল্পে প্রশিক্ষিত করার কর্মসূচি শুরু করল প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবারই বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ২৩ জন মহিলাকে একমাসের প্রশিক্ষণ শেষ করলেন বিশিষ্ট সের-পাই শিল্পী ভোলানাথ কর্মকার। প্রশিক্ষণ শিবিরে সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী রুমাদেবীও।
ঘটনা হল, চল্লিশের দশকে খয়রাশোলের লোকপুরের বাসিন্দা কমলাকান্ত কর্মকারের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছিল ওই শিল্পের। আগেকার জিনিস মাপার পরিচিত মাধ্যম ‘সের’ ও ‘পাই’কে আলাদা রূপ দিয়েছিলেন তিনি। কাঠের সের ও পাইয়ের উপর পিতলের কারুকার্য করে প্রশংসা পেয়েছিলেন সকলের। নিজের সৃষ্ট ওই শিল্পকে নিয়ে ব্যবসায়িক ভাবে সফলও হয়েছিলেন। শিল্প সৃষ্টির জন্য ১৯৬৫ সালে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। বংশ পরম্পরায় সেরপাই শিল্পকে আকড়ে ধরে জীবিকা নির্বাহ করেছে কর্মকার পরিবারের তিন প্রজন্ম। তার পরেই সমস্যার সূত্রপাত।
বয়স বেড়ে যাওয়ায় কমলাকান্তবাবুর নাতি কার্তিক কর্মকার (কিছু দিন আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে) সে ভাবে আর ওই কাজ করতে পারছিলেন না। অন্য দিকে, কার্তিকবাবুর দুই ছেলেও ওই শিল্পকর্মে সে ভাবে উৎসাহী ছিলেন না। কাজটি মূলত চালাচ্ছেন কার্তিকবাবুর শিষ্য তথা জামাই ভোলানাথ কর্মকার এবং মেয়ে রুমা কর্মকারেরা। তাঁরাই এখনও পর্যন্ত কমলাকান্তের যোগ্য উত্তরসূরি। কিন্তু, ভোলানাথবাবুদের তিন মেয়ে যে শেষ পর্যন্ত এই পেশায় আসবে, এমন নিশ্চয়তা না থাকার জন্যই বছর দুয়েক আগে উদ্যোগী হন খয়রাশোলের তৎকালীন বিডিও মহম্মদ ইসরার।
বিডিও-র ভাবনাতেই ব্লক থেকে প্রকাশিত ২০১৩ সালের ডায়েরির প্রচ্ছদে জায়গা পেয়েছিল বিপন্ন সের-পাই শিল্পের ছবি। জেলা আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত করেছিলেন শিল্প বাঁচাতে স্বনির্ভর দলের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে। ইসরারের বক্তব্য ছিল, ‘‘ব্লকের গর্বের এই কুটির শিল্পকে বাঁচাতে বিভিন্ন কর্মসূচি না নেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে ‘সের-পাই’ বা ‘সিউড়ি বোল’ (জেলার বাইরের মানুষ যে নামে এই শিল্পকে চেনেন) শিল্পের কোনও অস্তিত্বই থাকবে না।’’ স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে তখনই প্রথম একটি প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করা হয়।
খয়রাশোলের বিডিও এখন তারকনাথ চন্দ্র। কিন্তু, ওই বিশেষ শিল্পকে বাঁচানোর উদ্যোগ থেমে নেই ব্লক প্রশাসনের পক্ষে। তাই এ বারও প্রশিক্ষণ পেলেন স্বনির্ভর দলের সদস্যেরা। তারকবাবু অবশ্য জানাচ্ছেন, ব্লক প্রশাসন পাশে থাকলেও স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার সুশোভন বন্দ্যেপাধ্যায়-ই সব করেছেন। আর সুশোভবনবাবু নিজে বলছেন, ‘‘১ লক্ষ ১৯ হাজার ৪২০ টাকা ব্যয়ে মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ শিবির থেকে উৎপাদিত দ্রব্য গত বার আমরা সবলা মেলায় প্রদর্শন করেছিলাম। ভাল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এ বারও সেটা করা হবে। পাশাপাশি শিল্পটাও বাঁচবে।’’
প্রশিক্ষণ চলাকালীন খয়রাশোলের লোকপুর গ্রামে সের-পাই শিল্পী ভোলানাথবাবুর বাড়িতে গিয়েও দেখা যায়, কাজ শিখছেন মহিলারা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাঠের টুকরো, পিতলের টুকরো। তা থেকেই কাঠের তৈরি সের-পাই বানানো ও সেগুলিকে অলঙ্কৃত করা, পিতলের পাত দিয়ে তৈরি ঝকঝকে বিভিন্ন কারুকার্য তৈরি করা যত্ন করে শিখিয়ে দিচ্ছিলেন সের-পাই শিল্পী দম্পতি ভোলানাথবাবু এবং রুমাদেবী। বৃহস্পতিবারই ছিল প্রশিক্ষণের শেষ দিন। জানা গেল ২৩ জনের দলে আট জন আগে এক বার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বাকি ১৫ জন একেবারেই নতুন। দু’বার প্রশিক্ষণ শিবির যোগ দেওয়া ‘চেতনা’ স্বনির্ভর দলের মায়া কর্মকার, ‘প্রীতিলতা’ দলের ঝুম্পা দত্ত বা এ বারই প্রথম এ কাজে প্রশিক্ষণ নেওয়া ‘দুর্গা’ স্বনির্ভর দলের সদস্য গোপা দে, ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ দলের সদস্য সুলতা চৌধুরীরা বলছেন, ‘‘কাজ শিখে আমরা খুশি। যতটুকু কাজ শিখেছি, তাতে সাহায্য করতে পারব।’’ তবে, সকলেরই একটাই আক্ষেপ, ‘‘এই কাজ শেখা সহজ নয়। প্রশিক্ষণ শিবির আরও এক মাস বাড়লে কাজ শিখতে আরও সুবিধা হতো।’’
বিভাগের জেলা আধিকারিক মৌসুমী পাত্র জানান, মূলত দু’টি উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছে। প্রথমত, বীরভূমের গর্বের ‘সের-পাই’ শিল্প যেন বাঁচে। দুই, এই কাজ শিখে বা মূল শিল্পীকে সাহায্য করে যেন অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা লাভবান হন স্বনির্ভর দলের মহিলারা। ‘‘ওঁরা আরও কিছু দিন প্রশিক্ষণ নিতে চান। তাই প্রশিক্ষণের অনুমোদন এলে এ নিয়ে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করব,’’—বলছেন মৌসুমীদেবী।
কী বলছেন শিল্পী দম্পতি? দু’জনেরই বক্তব্য, ‘‘কাজের চাহিদা আছে। বাজার ভাল। কিন্তু, একটি পরিবারের পক্ষে বেশি পরিমাণে সের-পাই উৎপাদন সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতিতে সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষিত মহিলা সদস্যেরা সাহায্য করতে পারলে দু’পক্ষেরই লাভ হবে।’’