নিশ্ছিদ্র: (বাঁ দিকে) আদালতে নিয়ে আসা হল ‘অপহৃতাকে’ (সবুজ ওড়না), ভিড়ের চাপে বেসামাল নিরাপত্তাকর্মী হোঁচট খেলেন সার দিয়ে রাখা মোটরবাইকে। (ডান দিকে) পুলিশের ঘেরাটোপে আদালতে নিয়ে আসা হল অপহরণ-কাণ্ডে গ্রেফতার বিজেপির জেলা কমিটির নেতা তথা ওই তরুণীর বাবা সুপ্রভাত বটব্যালকে (কমলা কাপড়ে মুখ ঢাকা)। সোমবার। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
তুমুল হুড়োহুড়ি তখন চলছে আদালত চত্বরে। সোমবার বিকেল। জনতার ঠেলায় হুড়মুড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে সার দিয়ে রাখা মোটরবাইক, সাইকেল। ভিড়ের চাপে উল্টেছে আদালতের বারান্দায় থাকা একের পর এক চেয়ার। কোনও মতে জনতাকে সরিয়ে বোলপুর আদালতের এসিজেএম অরবিন্দ মিশ্রের এজলাসে ঢোকানো হল লাভপুর-কাণ্ডে ‘অপহৃতা’ তরুণীকে।
হই-হট্টগোলের মধ্যেই কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়ে মিশে থাকা ওই তরুণীর কয়েক জন পরিজন চিৎকার করে শুধু বললেন, ‘‘সব সত্যি কথা বলবি! তোর পিছনে আমরা রয়েছি।’’ ততক্ষণে পুলিশ ওই তরুণীকে ঢুকিয়ে দিয়েছে এজলাসে। ঘড়িতে তখন সওয়া ৪টে।
আদালত চত্বরে ভিড়টা অবশ্য জমতে শুরু করেছিল তার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই। ওই অপহরণ-কাণ্ডে আদালত কী রায় দেয়, তা জানতে উৎসুক ছিল সাধারণ মানুষ। ছিলেন বিজেপি-র নেতা-কর্মীরাও। ভিড় সামলাতে বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে আদালত চত্বরে ছিলেন এসডিপিও (বোলপুর) অভিষেক রায়। ঘিরে রাখা হয় কোর্ট লকআপ-ও।
দুপুর সওয়া ২টো। দু’টি আলাদ গাড়িতে তিন অভিযুক্তকে নিয়ে আদালতে পৌঁছয় পুলিশ। একটি গাড়িতে ছিলেন ওই তরুণীর বাবা সুপ্রভাত বটব্যাল। অন্য গাড়িতে বাকি দুই অভিযুক্ত রাজু সরকার, দীপঙ্কর মণ্ডল। সকলেরই মুখ ঢাকা কাপড়ে। ভিড়ে তখন চাঞ্চল্য। হাজির বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়, সাধারণ সম্পাদক কালোসোনা মণ্ডলেরা।
লাভপুর অপহরণ-কাণ্ডে শুনানির জন্য ভিড় সামলাতে বোলপুর আদালতে মোতায়েন বিশাল পুলিশ বাহিনী।
দুপুর আড়াইটে নাগাদ শুরু হয় শুনানি। এজলাসেও তিন অভিযুক্তের মুখ বাঁধা দেখে বিচারক প্রশ্ন করেন— ‘‘ওঁদের মুখ ঢাকা কেন?’’ এর পরেই শনাক্তকরণের জন্য এজলাস থেকে বের করে দেওয়া হয় অন্য সবাইকে। বেরিয়ে আসেন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও।
অভিযুক্তদের হয়ে আইনজীবী ছিলেন জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি প্রশ্ন তোলেন— ওই তরুণীর জবানবন্দি না নিয়ে কী ভাবে তাঁর বাবাকে এই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেফতার করা হল। কী ভাবে দেওয়া হল পুলিশ হেফাজতে রাখার আবেদন।
তা নিয়ে দু’পক্ষের আইনজীবীর মধ্যে বাদানুবাদ চলে। বিচারক জানিয়ে দেন, আগে ওই তরুণীর গোপন জবানবন্দি রেকর্ড করা হবে। তার পরে ফের শুনানি করবেন তিনি। ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ অফিসারকে ওই তরুণীকে আদালতে পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সরকারি আইনজীবী ফিরোজ কুমার পাল জানান, বোলপুর সিয়ান হাসপাতালে ওই তরুণীর মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাঁকে হাজির করানোর নির্দেশ দিয়ে এজলাস থেকে উঠে যান বিচারক। ঘড়িতে তখন দুপুর তিনটে বাজতে পাঁচ।
‘অপহৃতা’কে আদালতে পেশ করতে তোড়জোড় শুরু করে পুলিশ। ধৃত তিন জনকে ফের নিয়ে যাওয়া হয় কোর্ট লকআপে। তরুণীকে নিয়ে আসার খবর ছড়াতেই ভিড় আরও বাড়তে থাকে আদালত চত্বরে।
বিকেল সওয়া চারটে। ওই তরুণীকে নিয়ে আদালত চত্বরে পুলিশ পৌঁছতেই শুরু হয় হুড়োহুড়ি। কোনও মতে ভিড় হটিয়ে মেয়েটিকে এজলাসে ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ।
ধাক্কাধাক্কির জেরে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন ওই তরুণী। এসিজেএমের নির্দেশে কয়েক মিনিট পরে তাঁকে ওই এজলাস থেকে বের করে মহকুমা আদালতের দোতলায় জেএম (২) মণিকুন্তলা রায়ের এজলাসে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই তরুণী পুলিশকে বলেন, ‘‘একটু আস্তে নিয়ে চলুন, আমার শরীর খারাপ লাগছে।’’ সন্ধ্যা সওয়া ৭টা পর্যন্ত তাঁর গোপন জবানবন্দি রেকর্ড করার প্রক্রিয়া চলে। তার পরে ফের তাঁকে এসিজেএমের এজলাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
অপহরণ-কাণ্ডে গ্রেফতার বিজেপি নেতা সুপ্রভাতবাবুকে ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানোর আর্জি জানিয়েছিলেন সরকারপক্ষের আইনজীবী ফিরোজকুমার পাল। বিচারক তাঁকে ১১ দিনের পুলিশ হেফাজত মঞ্জুর করেন। ওই তরুণী আইনজীবীর মাধ্যমে বিচারককে জানান, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই তাঁকে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানো হোক। বিচারক আপাতত তাঁকে সিউড়ির একটি হোমে রাখার নির্দেশ দেন। অন্য দুই অভিযুক্ত রাজু ও দীপঙ্করকে পাঠানো হয় জেল হেফাজতে। সেখানে তাঁদের ‘টিআই’ প্যারেডেও হাজির করানো হবে। সরকারি আইনজীবী জানান, গ্রেফতার হওয়ার পরে ওই দু’জন অপহরণ-কাণ্ডে সুপ্রভাতবাবুর জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিলেন। সে জন্যই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।
সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বিজেপির রাজ্য নেতারা পৌঁছন আদালত চত্বরে। রাজ্য সহ-সভাপতি বিশ্বপ্রিয় রায়চৌধুরী, রাজ্য সম্পাদক রাজীব ভৌমিকেরা কথা বলেন সুপ্রভাতবাবুর বাড়ির লোকেদের সঙ্গে। সহ-সভাপতি দিলীপবাবু সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘তরুণীর গোপন জবানবন্দি না নিয়েই তাঁর বাবাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এটা অন্যায়। বিচারক আমাদের আর্জি শুনে গোপন জবানবন্দি রেকর্ড করার নির্দেশ দেন।’’
গত বৃহস্পতিবার লাভপুরের বাবুপাড়ায় বিজেপি-র জেলা কমিটির সদস্য সুপ্রভাবতবাবুর বাড়িতে ঢুকে অস্ত্র দেখিয়ে তাঁর মেয়েকে তিন দুষ্কৃতী অপহরণ করে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ উঠেছিল। ঘটনার কথা ছড়াতেই উত্তাল হয় লাভপুর। রাস্তার মোড়ে মোড়ে টায়ার এবং ডালপালা জ্বালিয়ে কার্যত গোটা এলাকা অবরুদ্ধ করে রাখে উত্তেজিত জনতা। কার্যত অঘোষিত বন্ধের চেহারা নিয়েছিল গোটা শহর। অশান্তির আঁচ ছড়ায় কীর্ণাহার, মহেশপুরেও। অপহরণ-কাণ্ডে শাসকদলের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি। তা উড়িয়ে দেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
অপহৃতের খোঁজে পুলিশের পাশাপাশি তদন্ত চালায় সিআইডি। নিয়ে আসা হয়েছিল পুলিশ কুকুরও। রবিবার সিউড়িতে সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশ দাবি করে, উত্তরবঙ্গের ডালখোলা থেকে ওই তরুণীকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুই অভিযুক্তকে। পুলিশকর্তা দাবি করেন, ওই ঘটনার ছক কষেছিলেন সুপ্রভাতবাবুই। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়। বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে সুপ্রভাতবাবুকে।
এ দিন আমোদপুরে দলীয় কর্মিসভায় লাভপুর-কাণ্ড নিয়ে বিধায়ক মনিরুল ইসলামকে কার্যত ‘ক্লিনচিট’ দিয়ে অনুব্রত বলেন, ‘‘মনিরুল ইসলাম নয়, মেয়ে বলেছে, অপহরণে তাঁর বাবাই মুল চক্রী। নকশালবাড়িতে তাঁর বন্ধুরা রয়েছে। তাঁদের সাহায্যে মেয়েকে অপহরণ করিয়ে তৃণমূলের নামে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন।’’
অন্য দিকে, কলকাতায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘প্রকৃত ঘটনা তদন্তের পরে জানা যাবে। কিন্তু পুলিশ বা গোয়েন্দারা জানার আগেই অনুব্রত মণ্ডল কী করে সত্য জানতে পারলেন, সেটা আমরা জানতে চাই। গোয়েন্দারা কি আজকাল তাঁকেই রিপোর্ট করছেন? নাকি তিনি তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘পুলিশ যে কোনও লোককে দিয়ে যা খুশি লিখিয়ে নিতে পারে। সেই জন্য আমরা চাইছি, মেয়েটির গোপন জবানবন্দি নেওয়া হোক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy