Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
দেখল ইউনিসেফ

মেয়েদের ভাষা দিয়েছে কন্যাশ্রী ক্লাব

প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ইউনিসেফ এই জেলায় কন্যাশ্রী ক্লাব তৈরি করেছে। লক্ষ্য বাল্যবিবাহ রোধ করা, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যার সচেতনতা তৈরি করা, স্কুল ছুটদের স্কুলে ফেরানোর কাজ ওই ক্লাবের সদস্য ছাত্রীরা করবে।

নিজেদের কথা বলছে ঝালদার এক স্কুল ছাত্রী।  ছবি: সুজিত মাহাতো

নিজেদের কথা বলছে ঝালদার এক স্কুল ছাত্রী। ছবি: সুজিত মাহাতো

প্রশান্ত পাল
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৭ ০২:৩০
Share: Save:

নিজের নামে জীবনে প্রথম এক সঙ্গে অনেকগুলো টাকা পেয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে পাড়ার এক দুঃস্থ শিশুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে নজির তৈরি করেছে ঝালদা গার্লস হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী নেত্রা পোদ্দার। মঙ্গলবার বৃষ্টি ভেজা বিকেলে ঝালদায় নেত্রার মুখে এই কথা শুনে কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন ইউনিসেফের প্রতিনিধিরা।

প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে ইউনিসেফ এই জেলায় কন্যাশ্রী ক্লাব তৈরি করেছে। লক্ষ্য বাল্যবিবাহ রোধ করা, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যার সচেতনতা তৈরি করা, স্কুল ছুটদের স্কুলে ফেরানোর কাজ ওই ক্লাবের সদস্য ছাত্রীরা করবে। সেই কাজ কেমন চলছে, তা সরেজমিনে দেখতে মঙ্গলবার দু’দিনের সফরে পুরুলিয়ায় এসেছেন ইউনিসেফের প্রতিনিধিরা।

এ দিন বিকেলে তাঁরা ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া ঝালদা গার্লস হাইস্কুলে যান। সেখানে কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেন ইউনিসেফের রাজ্যের অ্যাডোলেসেন এনগেজমেন্ট স্পেশালিস্ট স্বপ্নদীপা বিশ্বাস, মৌমিতা দস্তিদার, জেলার প্রতিনিধি অনুরুদ্ধ রায় প্রমুখ। তাঁদের কাছে ওই ক্লাবের সম্পাদক ঝালদার পোদ্দারপাড়ার মেয়ে নেত্রা জানায়, গত জানুয়ারি মাসে কন্যাশ্রী প্রকল্প থেকে সে সাড়ে সাতশো টাকা পেয়েছিল। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নেত্রার কথায়, ‘‘জীবনে প্রথমবার আমার বড় পাওনা, তাই খরচ করতে মন চাইছিল না। কিন্তু পাড়ার এক দুঃস্থ দিদির কাছে শুনি, তিনি তাঁর চার বছরের মেয়েকে একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করতে চান। সে জন্য প্রায় চারশো টাকা দরকার। কিন্তু ওই টাকা তাঁর নেই। তিনি দুঃখ করছিলেন। তখন সাত-পাঁচ না ভেবেই আমি তাঁকে কন্যাশ্রী থেকে পাওয়া টাকা হাতে ধরিয়ে দিই।’’ এ কথা শুনে প্রতিনিধিরা তাজ্জব হয়ে যান। নেত্রার এই কাজের জন্য তাকে বাহবা দেন তাঁরা।

শুধু নেত্রাই নয়। তাঁর ক্লাবের বাকিরাও কম নয়। ওই স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী শ্বেতা সিংহ জানায়, এক বছর আগে তখন সবে কন্যাশ্রী ক্লাব তৈরি হয়েছে। নাবালিকা বিয়ে বন্ধের জন্য তাঁরা এলাকায় সচেতনতার কাজ শুরু করেছিল। তখন স্কুলেরই নিচু ক্লাসেরই একটি মেয়ে শ্বেতাকে জানিয়েছিল, তার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মেয়েটি পড়তে চায়। শ্বেতারা তাকে প্রতিবাদ করতে বলে। পরে শ্বেতা একাই ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে বিয়ে বন্ধ করতে অনুরোধ করেছিল। এ দিন আক্ষেপ জড়ানো গলায় শ্বেতা বলে, ‘‘সে দিন ওই ছাত্রীর বাড়ির লোকজন আমাকে অপমান করেছিল। বিয়েটা বন্ধ করতে পারিনি। তবে, এ বার আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’’ ‘উড়ান’ কন্যাশ্রী ক্লাবের মেয়েরা সমস্বরে বলে ওঠে— ‘‘নাবালিকাদের বিয়ে বন্ধ করতে না চাইলে এ বার আমরা চাইল্ডলাইনকে জানাব, ব্লক অফিসে যাব। ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের কোনও ভাবেই বিয়ে হতে দেব না।’’

স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৪৮০ জন মেয়েকে নিয়ে কন্যাশ্রী ক্লাব তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে ৩২ জনের কমিটি। এই কমিটির সদস্য আমনা খাতুন বলে, ‘‘গত বছর নেতাজি ইন্ডোরে কন্যাশ্রী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাছে ডেকে আমাকে বলেছেন, বড় হও। এগিয়ে যাও। তাঁর এই বার্তা আমাদের এলাকার সমস্ত মেয়ের জন্য। সেটাই আমাদের এগিয়ে চলার পাথেয়।’’

সেই কথার সূত্র ধরে স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কন্যাশ্রী ক্লাব মুখচোরা মেয়েগুলোর মুখ খুলে দিয়েছে। ওরা এলাকায় গিয়ে স্কুল ছুটদের ফিরিয়ে আনছে, নাবালিকা বিয়ে রুখে দিচ্ছে— সব মিলিয়ে একটা আন্দোলনের রূপ দিয়েছে। এর থেকে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে?’’ স্বপ্নদীপা বলেন, ‘‘এটাই আমরা চেয়েছিলাম। ওদের কাজ দেখে ভাল লাগছে।’’

জেলাশাসক অলকেশ প্রসাদ রায় অবশ্য দুপুরেই ইউনিসেফের প্রতিনিধিদের জানিয়েছিলেন, কন্যাশ্রী ক্লাব জেলায় সাড়া জাগিয়েছে। ২০টির মধ্যে ১০টি ব্লক ও তিনটি পুরসভায় ১৭৩ কন্যাশ্রী ক্লাব কাজ শুরু করেছে। অনেক জায়গায় ছেলেরাও ওদের সঙ্গে সামিল হয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছে কন্যাশ্রী ক্লাব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kanyashree Scheme Humanity Jhalda ঝালদা
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE