নাচ: কাটানধার এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র।
লম্ফঝম্প করছে জাম্বুবান, হনুমান, সুগ্রীব ও বিভীষণ। সেই সঙ্গে বাজনার জগঝম্প। তাদের ঘিরে থাকা জটলার ছোটদের মুখ শুকনো, কেউ বা ভ্যাঁ করে কান্না জুড়েছে। প্রতিবারের মতো এ বারও দুর্গাপুজো শেষে রবিবার থেকে রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্রের সাজে ‘রাবণ কাটা’ উৎসবে মেতেছে বিষ্ণুপুর। আজ, সোমবার দ্বাদশীর দিনে কাটানধারে রঘুনাথ জিউ মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠান দিয়ে শেষ হবে এই উৎসব।
পর্যটননগরী বিষ্ণুপুরে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনের পরেও আনন্দের রেশ মিলিয়ে যায় না। লোকশিল্পীদের মুখোশ সেঁটে রংচঙে পোশাক পরে রাবণ কাটা নাচ বাড়তি আনন্দ নিয়ে আসে। এই সময় বহু পর্যটক বিষ্ণুপুর বেড়াতে আসেন। তাঁরাও এই লোকশিল্প দেখে আনন্দ পান।
শনিবার কাটানধারের রঘুনাথজিউ মন্দিরে পুজো দেওয়ার পরে লোকশিল্পীরা কুম্ভকর্ণ বধ অভিনয় করেন। শহর পরিক্রমায় বেরোন রবিবার সকাল থেকে। এ দিন হয়েছে ইন্দ্রজিৎ বধ, সোমবার হবে রাবণ বধ। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামপ্রসাদ মিশ্র দাস মহন্ত বলেন, ‘‘রঘুনাথজিউয়ের পুজোর স্নানজল নিয়েই শহর পরিক্রমায় বেরোন শিল্পীরা। মন্দিরে তাঁদের জন্য খাবার থাকে।’’
এ বার জাম্বুবান সেজেছেন পেশায় কৃষক নারায়ণ বারিক, আইসক্রিম বিক্রেতা সুকুমার অধিকারী সেজেছেন হনুমান। পেশায় রাজমিস্ত্রির হেল্পার মিঠুন লোহার সেজেছেন সুগ্রীব। সাইকেল নিয়ে হুড়মুড়িয়ে মন্দির চত্বরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে বিভীষণ, থুড়ি পেশায় আনাজ বিক্রেতা রঞ্জিৎ গড়াই বলেন, ‘‘খদ্দের ছাড়তেই চায় না। এ দিকে রাবণ কাটার বাজনা তো আমকে ডাকছে। আর কি ব্যবসায় মন বসে? আনাজ ফেলে দৌড়ে চলে এলুম।’’
নারায়ণ বারিক বলছিলেন, ‘‘রাবণ কাটা নাচ দেখে লোকে খুশি হয়ে যা দেন, তা বিশেষ কিছু নয়। কিন্তু নিজেদের পেশার এক ঘেঁয়েমি কাটাতে একটু আনন্দ খুঁজে নিতে আমরা রাবণ কাটা নাচে যোগ দিতে বেড়িয়ে পড়ি।’’ নাচের বাজনা কাড়া, নাকড়া ঝালিয়ে নেওয়ার ফাঁকে বাজনদার তারাপদ ধাড়া, রাজেশ ধাড়া বলেন, ‘‘এই সময়টা বাড়িতে মন টেকে না। কাড়া-নাকড়াগুলো যেন বলে, যাবি না বাজাতে?’’ উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র রাজেশ ধাড়াও পূর্বপুরুষদের ধারা মেনে বাজনা বাজাতে বেরিয়ে পড়েছে। নৃত্যশিল্পী, বাজনদার প্রত্যেকের একটাই কথা, ‘‘শহর জুড়ে ঘোরার সময় বাচ্চাগুলোর ভয়, আমোদ— এ সব দেখে আমাদের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।’’ তবু একটা চাহিদা তাদের রয়ে গিয়েছে। জাম্বুবান সাজা নারায়ণ বারিক বলেন, ‘‘লোকশিল্পীদের জন্য সরকার মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করছে। আমাদেরও যদি সেই সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে আগামী প্রজন্মও এই লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উৎসাহী হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy