Advertisement
E-Paper

মদ-বিরোধী অভিযানে দিশা দেখাচ্ছে ফেউগ্রাম

বিয়ে হওয়া ইস্তক স্ত্রী প্রতিমাকে একটি প্রেসার কুকারের জন্য ঘ্যানঘ্যান করতেন। পড়শি রাঙা বৌদির কাছেই স্ত্রী শুনেছিলেন, খুব কম সময়েই নাকি রান্না হয়ে যায় কুকারে । স্ত্রীর বায়না মেটাতে না পেরে সে দিন মনে মনে রাঙা বৌদিকেই একহাত নিয়েছিলেন পেশায় রাজমিস্ত্রী আনন্দ কোনাই।

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৫৫
ঘরে ঘরে গিয়ে চলছে বোঝানোর পালা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

ঘরে ঘরে গিয়ে চলছে বোঝানোর পালা। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

দৃশ্য ১: বিয়ে হওয়া ইস্তক স্ত্রী প্রতিমাকে একটি প্রেসার কুকারের জন্য ঘ্যানঘ্যান করতেন। পড়শি রাঙা বৌদির কাছেই স্ত্রী শুনেছিলেন, খুব কম সময়েই নাকি রান্না হয়ে যায় কুকারে । স্ত্রীর বায়না মেটাতে না পেরে সে দিন মনে মনে রাঙা বৌদিকেই একহাত নিয়েছিলেন পেশায় রাজমিস্ত্রী আনন্দ কোনাই।

দৃশ্য ২: ছেলে সঞ্জয়কে স্কুল ইউনিফর্ম কিনে দিতে না পেরে মনে মনে শিক্ষকদের মুন্ডুপাত করেছিলেন পেশায় দিনমজুর অনিল হাজরা।

দুই পরিবারই এখন গ্রামের ক্লাবের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যে ক্লাবের দৌলতে মাসখানেকের মধ্যেই আনন্দবাবুরা স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের দীর্ঘ দিনের চাহিদা পূরণ করতে পেরেছেন। না, ওই ক্লাব কোনও অনুদান কিংবা ঋণ দিয়ে অনিলবাবুদের পরিবারের সাধ মেটায়নি। বরং কঠিন অনুশাসনে ক্লাব তাঁদের মদের নেশা ভুলিয়ে ছেড়েছে। আর তার জন্যই মদ বাবদ বরাদ্দ টাকা বেঁচে যাওয়ায় পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পেয়েছেন তাঁরা। শুধু অনিল হাজরা বা আনন্দ কোনাই-ই নয়, নিজের গ্রামের পাশাপাশি কাছেপিঠের আরও গ্রামেও প্রভাব ফেলেছে নানুরের ফেউগ্রামের এই ‘মদ বিরোধী অভিযান’। ওই গ্রামের দেখাদেখি মদ হঠাতে এককাট্টা হয়েছে লাগোয়া ওই সব গ্রাম।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, নানুরের ফেউগ্রামে প্রায় সাড়ে চারশো পরিবারের বাস। তফশিলি জনজাতিভুক্ত পরিবারের সংখ্যাই প্রায় দুই শতাধিক। অন্যান্য আর পাঁচটা গ্রামের মতোই ফেউগ্রামেও এক সময় বেআইনি মদের রমরমা কারবার ছিল। ওই মদ খেয়ে গ্রামের মানুষ তো বটেই, বহিরাগতেরাও মাতাল হয়ে নিত্য দিন পাড়া মাথায় করে তুলত। তাদের মাতলামিতে জনজীবন অতিষ্ট হয়ে উঠলেও মাতালদের কেউ ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না। তাই মাতালদের উপদ্রব কার্যত গা-শোওয়া হয়ে গিয়েছিল সবার। স্বযত্নে পাশ কাটিয়ে যাওয়াটাই ছিল এত দিনের রেওয়াজ।

কিন্তু, মাসখানেক আগে এক বধূর আত্মহত্যার ঘটনায় নাড়িয়ে দেয় ফেউগ্রামকে। মদ্যপ স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ওই বধূ আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে অভিযোগ। তাঁর অন্ত্যষ্টির পরেই স্থানীয় ‘মিলন মন্দির ক্লাবে’র নেতৃত্বে মদ বিরোধী অভিযানে নামার সিদ্ধান্ত নেন গ্রামবাসী। যারা বেআইনি মদ তৈরি এবং বিক্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলে আসা হয় ব্যবসা ছাড়তে হবে। না হলে তুলে অভিযুক্তদের তুলে দেওয়া হবে পুলিশের হাতে।

ওই হুঁশিয়ারিতেই কাজ হয়। কিন্তু, সমস্যা দেখা দেয় মদ্যাসক্তদের নিয়ে। তারা দিব্যি বাইরে থেকে মদ খেয়ে যথারীতি পাড়া মাথায় তুলতে থাকেন। ওই সব মাতালদের জন্য দেওয়া হয় নতুন দাওয়াই। বলা হয়, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় গ্রামে ঢুকলেই শান্তিভঙ্গের অভিযোগে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে! ক্লাবের অন্যতম সদস্য রামানন্দ সাহা, ইন্দ্রজিৎ ঘোষরা বলছেন, ‘‘ওই দাওয়াই দু’দিক থেকে কাজে লাগে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় নেশার ঘোর না কাটায় সারা রাত মশা কামড় খেয়ে সকালে বাড়ি ফিরে পরিবারের সামনে ল্যাজেগোবরে হয়ে মদ ছেড়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ চুপচাপ বাড়ি ফিরে অন্যকে উত্যক্ত করে মদ খাওয়ার জানান দিতে না পারার মজা হারিয়েও একই পথে এসেছেন!’’ তাই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন গ্রামের মানুষ। পুর্ণিমা মণ্ডল, প্রতিমা কোনাইরা বলেন, ‘‘নিজেদের শখ–আহ্লাদ তো দূরের কথা, ছেলেমেয়েদের মুখে দু’বেলা দু’ মুঠো খাবারও তুলে দিতে পারিনি সব সময়। কারণ, রোজগারের সিংহ ভাগ নেশার পিছনে খরচ করে বাড়ি ফিরে তুমুল অশান্তি বাঁধাতেন পুরুষেরা। মাসখানেক ধরে সেই অশান্তি নেই। তাই আর মদ ঢুকতে দেব না গ্রামে।’’

নেশাই যত অশান্তির মূল, তা আজ মানছেন মিহির মণ্ডল, আনন্দ কোনাইরাও। তাঁরা বলছেন, ‘‘আমরা যা রোজগার করি, তা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ, ছোটখাটো চাহিদা পূরণ অনায়াসেই করা যায়। কিন্তু, মদ পেটে পড়লে আর সংসারের কথা মনে থাকে না। তা ছাড়া মদের সঙ্গে আরও অনেক বদ নেশাও আঁকড়ে ধরে।’’ কিন্তু, মাসখানেকের চেষ্টায় মদ ছেড়ে পরিবারের কিছু চাহিদা মিটিয়ে যে আনন্দ মিলেছে, তা নেশার চেয়ে অনেক বড় বলেই এখন তাঁদের মত। এ দিকে, ক্লাবের সভাপতি সদানন্দ পাল, সম্পাদক হরনাথ দত্তরা জানান, ইতিপূর্বে নেশার পিছনে সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেছেন বহু পরিবার। মাতাল স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন বহু স্ত্রী। কিন্তু, সাম্প্রতিক ওই বধূর আত্মহত্যার ঘটনা তাঁদের নাড়িয়ে দেয়। ‘‘অনুভব করি, আর জেগে ঘুমালে চলবে না।’’—বলছেন ওঁরা।

উদ্যোগ শুধু ফেউগ্রামেই থেমে থাকেনি। প্রভাব পড়েছে পার্শ্ববর্তী গ্রামেও। নানুর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য বিদ্যাধর সাহা জানান, ফেউগ্রামের প্রদর্শিত পথে মাদক বিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে গোমাই, মাধপুর, বলাইপুর-সহ বেশ কিছু গ্রামও। এই উদ্যোগে প্রশাসনও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে বলে তাঁর আশ্বাস। বলাইপুরের ফুলমণি হেমব্রম, লক্ষ্মী মুর্মরা বলছেন, ‘‘আমাদের গ্রামেও ছেলে-ছোকরারা মদ বন্ধের ডাক দিয়েছে। মাতালরা আচ্ছা জব্দ হয়েছে! সংসারের আঁধার কেটেছে।’’

Nanur Hooch Feugram Arghya Ghosh Purnima Mondal Laxmi Murmu abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy