Advertisement
E-Paper

একুশে তর্পণ সেই উনিশের

সন্ধ্যা নামছে। বড়গড়িয়া গ্রামের মোড়ে থিকথিকে ভিড়। লোকসেবক সঙ্ঘের নেতা হেম মাহাতো বক্তৃতা দিচ্ছেন— ‘‘কাল পুঞ্চা যেতে হবে। ওখান থেকে হেঁটে কলকাতা।

সমীর দত্ত 

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৮
(বাঁ দিক থেকে) নকুল মাহাতো ও বলরাম সিং। নিজস্ব চিত্র

(বাঁ দিক থেকে) নকুল মাহাতো ও বলরাম সিং। নিজস্ব চিত্র

সন্ধ্যা নামছে। বড়গড়িয়া গ্রামের মোড়ে থিকথিকে ভিড়। লোকসেবক সঙ্ঘের নেতা হেম মাহাতো বক্তৃতা দিচ্ছেন— ‘‘কাল পুঞ্চা যেতে হবে। ওখান থেকে হেঁটে কলকাতা। না হলে মানভূম আর বাংলায় অন্তর্ভুক্ত হবে না। চিরকাল বিহারেই থেকে যেতে হবে।’’

তখন বছর পনেরো বয়স ছিল। এখন আশি ছুঁইছুঁই। কিন্তু জলজ্যান্ত সেই ছবি, সেই কথা এখনও চোখের সামনে ভাসে বলরাম সিং-এর। বৃহস্পতিবার, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মানবাজারের বড়গড়িয়া হাইস্কুলে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন দুই প্রবীণ ভাষা সেনানী বলরাম সিং ও নকুল মাহাতো। পুরুলিয়া এখন বাংলায়। কিন্তু নিজের ভাষায় কথা বলার সেই অধিকার প্রায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পার করে অর্জন করে আনতে হয়েছিল। বলরামবাবু বলেন, ‘‘সে সব কথা পুরুলিয়ার বাইরে আর ক’জন জানেন? জেলার নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের কাছেও সেই ইতিহাস পৌঁছচ্ছে না। জানলে হয়তো নিজের ভাষাকে আরও সম্মান করতে শিখত তারা।’’

সাবেক মানভূম ছিল বিহারে। স্বাধীনতার পরেও সেটাই থেকে যায়। ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশের ভাগ চেয়ে তখন গঠিত হয় লোকসেবক সঙ্ঘ। তার পরে অনেক লড়াই। অনেক আন্দোলন। ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল পুঞ্চার পাকবিড়রা থেকে শুরু হয়েছিল পদযাত্রা। ৬ মে পৌঁছয় কলকাতায়। আজকের বঙ্গভুক্ত পুরুলিয়ার লাল মাটি সেই সমস্ত মানুষের ঘামে ভেজা।

বলরামবাবুর মনে পড়ে, ১৯ এপ্রিল। ১৯৫৬ সাল। পড়শি চারুচন্দ্র মাহাতো তখন লোকসেবক সঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য। সবাই তাঁকে মান্য করেন। তিনিই বাড়ির লোকজনকে বলেছিলেন, ‘‘বলরামও আমাদের সঙ্গে চলুক। আন্দোলন জোরদার করতে হবে।’’ সে দিন ভোরে যখন বেরোচ্ছেন, মায়ের চিন্তা ছিল পথে যদি খিদে পেয়ে যায়! সাতসকালে এক পেট পান্তাভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন আলু সেদ্ধ দিয়ে। আর থলিতে একটা শার্ট, একটা প্যান্ট। ১১টার মধ্যে হেঁটে পুঞ্চার পাকবিড়রায় সবাই হাজির। অগুনতি মাথার সারি সেখানে।

১৭ বছরের কিশোর নকুল দেখেছিলেন সেই জন অরণ্য। রাঙামেট্যা গ্রামের আশি পার করে ফেলা বৃদ্ধের স্মৃতি একেবারে তরতাজা। আজও বাস ধরে মানবাজারে রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে গিয়ে দলিল লেখার কাজ করেন। জানান, বাল্য জীবন কেটেছে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমে। নকুলবাবু বলেন, ‘‘মানভূমের জননী বলা হয় অতুল ঘোষের স্ত্রী লাবন্যপ্রভা দেবীকে। তিনি নিজে আমাকে বলেছিলেন, সঙ্গে যেতে।’’ তাঁর সঙ্গেই গরুর গাড়িতে চড়ে পৌঁছেছিলেন পাকবিড়রায়। থিকথিক করছে ভিড়। কিন্তু সবাই আস্তে কথা বলছেন। কোনও চেঁচামিচি নেই। এক জায়গায় শলাপরামর্শ করছেন অতুল ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, জগবন্ধু ভট্টাচার্য, ভজহরি মাহাতোর মতো তাবড় নেতারা। পুরো যাত্রায় লাবন্যপ্রভা দেবীর সঙ্গে ছিলেন নকুলবাবু। টুসু গান গাইতে গাইতে ভাষার দাবি নিয়ে জনজোয়ার আছড়ে পড়েছিল গঙ্গার ওপারে।

দুই ভাষা সেনানী বলেন, ‘‘পদযাত্রার পাঁচ মাস পরেই মানভূম ভেঙে পুরুলিয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হল। সে দিন খুব ধুমধাম হয়েছিল। বেলুন উড়েছিল। বাজনা বেজেছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তো আরও অনেকেই পদযাত্রায় ছিলেন, যাঁদের বিহারেই থেকে যেতে হয়েছে। সেই যন্ত্রণা এখনও বিদ্ধ করে।’’

International Mother Language Day Language Soldier
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy