Advertisement
E-Paper

কালী-কার্তিক, বাউলের উত্‌সব সোনামুখীতে

শাক্ত আর বৈষ্ণবের অদ্ভূত সহাবস্থান সোনামুখীতে। প্রাচীন শহর সোনামুখীর খ্যাতি যতটা কালীপুজোর জন্য, ততটাই বাউল মহোত্‌সবের জন্য। এ ছাড়া শিল্পকৃতীও কম নয় এই শহরের। পাগড়ির রেশম বস্ত্র থেকে রামায়ণ গানে এখনও সোনামুখীর সুনাম অক্ষুন্ন। সবে শেষ হয়েছে কালীপুজো। কিন্তু এ বারও সেই আগের মতোই উন্মাদনা দেখা গিয়েছে এই শহরে। সুউচ্চ এখানকার প্রতিমা। আর এ সব প্রতিমার সঙ্গে অনেক কাহিনি বা জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে। কার্তিক পুজো সামনেই। এই কার্তিক পুজো নিয়েও আড়ম্বরের শেষ নেই।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৩৪
বাউল উত্‌সবের পীঠস্থান। সোনামুখীর মনোহরতলা। ছবি: শুভ্র মিত্র।

বাউল উত্‌সবের পীঠস্থান। সোনামুখীর মনোহরতলা। ছবি: শুভ্র মিত্র।

শাক্ত আর বৈষ্ণবের অদ্ভূত সহাবস্থান সোনামুখীতে।

প্রাচীন শহর সোনামুখীর খ্যাতি যতটা কালীপুজোর জন্য, ততটাই বাউল মহোত্‌সবের জন্য। এ ছাড়া শিল্পকৃতীও কম নয় এই শহরের। পাগড়ির রেশম বস্ত্র থেকে রামায়ণ গানে এখনও সোনামুখীর সুনাম অক্ষুন্ন।

সবে শেষ হয়েছে কালীপুজো। কিন্তু এ বারও সেই আগের মতোই উন্মাদনা দেখা গিয়েছে এই শহরে। সুউচ্চ এখানকার প্রতিমা। আর এ সব প্রতিমার সঙ্গে অনেক কাহিনি বা জনশ্রুতি ছড়িয়ে রয়েছে। কার্তিক পুজো সামনেই। এই কার্তিক পুজো নিয়েও আড়ম্বরের শেষ নেই। এই দুই পুজো নিয়েই উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা দেখার মতো।

কাটোয়ার কার্তিক লড়াইয়ের মতো সোনামুখী শহরেও কালী ও কার্তিক পুজোয় একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ায় মেতে থাকে। বিসর্জনে আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে পুজো কমিটিগুলির মধ্যে। এখানকার কালী ও কার্তিকের নামও অভিনব। কোথাও ‘মাইতো কালী’, কোথাও আবার ‘সার্ভিস কালী’, কোথাও ‘ঘুর্ণি কার্তিক’, কোথাও ‘শিখা কার্তিক’। এক একটি মূর্তির উচ্চতাও ১২ থেকে ১৮ ফুট। বাঁকুড়ার বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, “কালী ও কার্তিকের এইসব নামের পিছনেও কিছু স্থানিক ইতিহাস আছে। যেমন এলাকায় বর্গি আক্রমণের সময় মাইতো কালীর প্রতিষ্ঠা। বর্গি হানা করলে মা-ই-তো বাঁচাবেন, এই বিশ্বাস থেকে ওই নামকরণ হয়। আবার কোনও চাকরি প্রার্থীর মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার পরে প্রতিষ্ঠিত হয় সার্ভিস কালী। ঘুর্ণায়মান মঞ্চের উপর কার্তিকের বিগ্রহ অবিরাম ঘুরে চলায় নাম হয়েছে ঘুর্ণি কার্তিক।” এলাকার প্রবীণরা জানান, সোনামুখীতে মূলত তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষের বাস ছিল। দুর্গাপুজোর সময়ে তাঁরা তাঁতের শাড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকায় পুজোয় সে ভাবে আনন্দ করার ফুরসত্‌ পেতেন না। তাই তাঁরা আনন্দ করতেন কালীপুজোয়। তখন কাপড় বিক্রির টাকাও তাঁদের হাতে চলে আসে। সে কারণেই এখানকার কালীপুজোয় এত ধুমধাম। তবে ইদানীং দুর্গাপুজোতেও কয়েকটি মণ্ডপে গত কয়েক বছর ধরে নতুনত্ব দেখা যাচ্ছে। শুধু সোনামুখীই নয়, তা দেখতে আশপাশের এলাকা থেকেও মানুষজন আসছেন।

বৈষ্ণব সাধনা নিয়েও এই শহরের নাম রয়েছে। সোনামুখীর মনোহর দাস ছিলেন বৈষ্ণব সাধক। তাঁর উপাস্য দেবতা শ্যামচাঁদ। এলাকার তন্তুবায়দের বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে, তিনি শ্রীরামনবমীর দিন স্বেচ্ছাসমাধি গ্রহণ করেন। সেই দিনটিকে স্মরণে রাখতে প্রধানত শিষ্যদের উদ্যোগে ওই দিন থেকে শুরু হয় মোচ্ছব। চলে তিন দিন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন বাউলের দল। অনেক বাউল আখড়া বসে। তিন দিনের এই আখড়ায় দিন ও সারা রাত ধরে চলে বাউল এবং কীর্তন গান। কেঁদুলির বাউল মেলার মতো এখানেও ভিড় জমান বহু রসিকজন। তাতে এলাকার বাসিন্দারা যেমন থাকেন, তেমনই বহু দূর থেকে আসা ভক্তেরাও থাকেন। বাঁকুড়া জেলার তৃতীয় পুরশহর সোনামুখীর প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৮৬। পুরপ্রধান কুশল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, প্রাচীন এই শহরে এখনও কালী, কার্তিক ও মনোহর দাসের বাউল মহোত্‌সবে মাতেন এলাকাবাসী। ২৬টি কালী ও ২৭টি বড় মাপের কার্তিক পুজো হয়। এখানে তিন দিনের বাউল আসরে আসেন দেশের নানা প্রান্তের শতাধিক বাউল ও কীর্তন শিল্পী।” তিনি জানান, ওই বড় উত্‌সবগুলিতে পুরসভার তরফে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হয়।

স্বর্ণময়ীতলায় কালী বিসর্জনের শোভাযাত্রা।—ফাইল চিত্র।

যদিও বাউল আখড়ার এক কর্তার ক্ষোভ, “উত্‌সবের ক’দিন এলাকায় সাফাই ছাড়া পুরসভা প্রায় কিছুই করে না। বহু আখড়া লাগোয়া জায়গায় আলো জ্বলে না। পথবাতি খারাপ হলে পাল্টানো হয় না। সংস্কার হয়নি প্রাচীন শ্রীধর মন্দিরেরও।”

বাস্তবিক তাই। মহাদানি গলির ভিতর গিয়ে দেখা গেল ১৮৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্রীধর মন্দিরের করুণ দশা। অপূর্ব টেরাকোটা মণ্ডিত ২৫ চূড়া বিশিষ্ট এই প্রাচীন মন্দিরের গায়ে গজিয়েছে গাছ। শ্রীধরের বর্তমান সেবাইত ভুবনমোহন গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “শুনেছি ভুবন রুদ্র মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিন পুরুষ ধরে আমরাই পুজো করছি। এখনও বহু দেশি-বিদেশী পর্যটক এই মন্দির দেখতে আসেন। শিল্পকর্মের প্রশংসা করে যান। কিন্তু এই মন্দিরের সংস্কার নিয়ে সরকারের মাথা-ব্যথা নেই।”

একই রকম ক্ষোভ শহরের তাঁত শিল্পীদের। এক সময়ে বাংলার অন্যতম সেরা রেশম বস্ত্রের আঁতুরঘর হিসেবে সোনামুখীর সুনাম ছিল। মূলত একসময় তাঁতি ও সুবর্ণ বণিকদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল এই শহর। সময়ের ফেরে রেশমের শাড়ি ছেড়ে এখন রেশমের পাগড়ি বোনেন প্রায় ২০০ জন তন্তুবায়। তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণবাজারের অসিত সু, শ্যামবাজারের সমর গুঁই বলেন, “একসময় কাবুলিওয়ালারা এসে আমাদের তাঁতশাল থেকে পাগড়ির রেশম কাপড় কিনে নিয়ে যেতেন। তখন ঠিকঠাক দাম পেতাম। এখন মহাজনদের হাতে পাগড়ি তুলে দিতে হয়। তাঁরা কলকাতার বড়বাজারে গিয়ে বিক্রি করে আসেন। ফলে লাভের গুঁড় পিঁপড়েই খেয়ে যাচ্ছে। আমাদের আয় কমেছে।” এর ফলে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এই পেশায় আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাঁদের দাবি, “সরকার বিক্রির ব্যবস্থা করে আমাদের পাশে দাঁড়াক।” সোনামুখীর বিডিও বিশ্বজিত্‌ ভট্টাচার্য বলেন, “তাঁতশিল্পীদের নিয়ে ক্লাস্টার গঠন করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।”

২৫ চূড়া বিশিষ্ট শ্রীধর মন্দিরের মতোই গিরিগোবর্ধন ও স্বর্ণমুখী দেবীর (কেউ বলেন স্বর্ণমুখী দেবী) মন্দির দর্শনীয়। বিডিও-র আশ্বাস, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কাছে শ্রীধর মন্দির অধিগ্রহণ করার প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে। অন্য মন্দিরগুলির সংস্কার নিয়ে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের কাছে তিনি জানাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। এখন হরনাথ-কুসুমকুমারী মন্দিরেও বহু দর্শনার্থী আসেন। সোনামুখীর আর এক গর্ব এখানকার রামায়ণ গানের শিল্পীরা। রামায়ণগানে এক সময় এখানকার শিল্পীদের বেশ সুনাম ছিল। এখনও সেই ধারা অল্প কয়েকজন ধরে রেখেছেন। বাসিন্দাদের আশঙ্কা, সরকার এগিয়ে না এলে সোনামুখীর সব গর্বের পালক একে একে হয়তো খসে পড়বে।

amar shohor swapan bandopadhyay sonamukhi latest news online news online latest news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy