সংরক্ষণের গেরোয় পড়েছে শাসকদলের দুই গুরুত্বপূর্ণ নেতার ওয়ার্ড। আর তারই জেরে রঘুনাথপুর পুরভোটের প্রার্থী তালিকা স্থির করতে কার্যত নাজেহাল তৃণমূল। কারণ ওই দুই নেতা বিদায়ী পুরবোর্ডের তৃণমূলের দলনেতা বিষ্ণুচরণ মেহেতা ও উপপুরপ্রধান বাসুদেব তিওয়ারিকে কোন ওয়ার্ডে পুর্নবাসন দেওয়া হবে সেটাই এখনও স্থির করে উঠতে পারেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রার্থী নিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। ফলে লোকসভার ফলের নিরিখে রঘুনাথপুর শহরে জনসমর্থনে দ্বিতীয় সারিতে উঠে আসা বিজেপি যেখানে ১৩টির মধ্যে দুই-তিনটি ওয়ার্ড বাদ দিয়ে বাকিগুলিতে প্রার্থী অনেকাংশে চূড়ান্ত করে ফেলেছে, সেখানে শাসকদল একটি ওয়ার্ডেও সর্বসম্মত ভাবে প্রার্থী স্থির করে উঠতে পারেনি।
বস্তুত রঘুনাথপুরে আসনগুলির সংরক্ষণের তালিকা প্রকাশের পরেই প্রার্থী স্থির করতে তৃণমূলকে যে বেশ বেগ পেতে হবে তা আগেই আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। দিন যত গড়িয়েছে তা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডটি তফশিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় এ বার এই ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে পারছেন না তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা বিষ্ণুচরণবাবু। ফলে তাঁকে কোথায় পুনর্বাসন দেওয়া যায় সেটাই এখন চিন্তার বিষয় দলীয় নেতৃত্বের। দল সূত্রে খবর, বিষ্ণুচরণবাবু নিজে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে আগ্রহী। কিন্তু ওই এলাকার স্থানীয় নেতা-কর্মীরা আবার অন্য একজনকে চাইছেন। এ দিকে বিষ্ণুচরণবাবু আবার নিজের ছেড়ে যাওয়া ১৩ নম্বরে অশোক দাসের নাম প্রস্তাব করেছেন দলের কাছে। কিন্তু ওই ওয়ার্ডে অন্য একটি গোষ্ঠী চাইছে নবরাজ বাউরিকে প্রার্থী করতে। নবরাজবাবু ২০০১ সালে রঘুনাথপুর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হয়েছিলেন। ফলে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড নিয়েও জটিলতা বেড়েছে। দলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “সংরক্ষণের জন্য বিদায়ী কাউন্সিলররা অন্য ওয়ার্ডে দাঁড়াতে আবেদন করতেই পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁর জেতার সম্ভবনা কত তাও খতিয়ে দেখা হবে।”
১ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী-পদের অন্যতম দাবিদার যুব তৃণমূলের শহর সভাপতি ভবেশ চট্টোপাধ্যায়। দলের একাংশ আবার এই ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলরের স্বামী বিজয় মহান্তিকে প্রার্থী করতে চাইছে। এ বার যুব তৃণমূল চাইছে, পুরসভার কয়েকটি ওয়ার্ডে তাদের সংগঠন থেকে প্রার্থী করা হোক। আবার বিজয়বাবুর সমর্থনে রয়েছেন ওয়ার্ড কমিটির বেশির ভাগ সদস্য। পাশের ২ নম্বর ওয়ার্ড তফশিলি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে পড়ায় সেখানে এ বার দাঁড়াতে পারছেন না বিদায়ী উপপুরপ্রধান বাসুদেব তিওয়ারি। এখানে প্রার্থী হিসেবে দু’জনের নাম উঠে এসেছে। বাসুদেববাবুর মন্তব্য, “এই ওয়ার্ডে অনেকের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু চূড়ান্ত প্রার্থী স্থির করার ক্ষেত্রে ওয়ার্ড কমিটির মতামত রয়েছে। কে প্রার্থী হবেন তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।” অন্য দিকে, আবার ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিষ্ণুচরণবাবু-সহ ওয়ার্ড কমিটির একাংশ চাইছে, এখানকার তৃণমূলের পুরনো কর্মী বিজয় গুঁইয়ের স্ত্রী জোত্স্না গুঁইকে প্রার্থী করতে। আবার অন্য একটি গোষ্ঠী পাপিয়া চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করতে চাইছে।
তৃণমূল সূত্রে খবর, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে খোদ পুরপ্রধান মদন বরাটের ওয়ার্ড নিয়েও সর্বসম্মত ভাবে প্রার্থী স্থির করা যায়নি। এখানে মদনবাবুকে প্রার্থী করা হচ্ছে বলে একপ্রকার স্থির হয়ে থাকলেও এই ওয়ার্ডের অন্যতম দাবিদার হিসাবে উঠে আসছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের দাপুটে এক নেতার নাম। ওই নেতার অনুগামীদের যুক্তি, নেতৃত্ব এ বার নতুন মুখ আনতে চাইছে। মদনবাবু টানা ১০ বছরের পুরপ্রধান। তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে। তার প্রমাণ লোকসভার ফলে চার নম্বরে তৃণমূলকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বিজেপি। এই ওয়ার্ড ধরে রাখতে তাই প্রার্থী বদলের দরকার বলে তাঁদের দাবি।
৫ নম্বর ওয়ার্ডেও লোকসভা ভোটে বিজেপি এগিয়ে থাকলেও এই ওয়ার্ডেও প্রার্থী হতে তৃণমূলের অনেকেই আগ্রহী। এখানে অন্যতম দাবিদার আরএসপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়া কাউন্সিলর নাজিয়া পারভিনের স্বামী শেখ মধু। আবার এই ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে চাইছেন সংরক্ষণের গেরোয় পড়ে যাওয়া ৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর দীনেশ শুক্ল। আবার উপপুরপ্রধান বাসুদেব তিওয়ারিকেও এই ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী করতে চাইছেন তাঁর অনুগামীরা। যদিও বাসুদেববাবু দাবি করেছেন, “কোনও ওয়ার্ড থেকেই প্রার্থী হওয়ার দাবি দলকে জানাইনি। দলীয় নেতৃত্ব যদি মনে করেন আমাকে প্রার্থী করা দরকার, তাহলে করবে।”
জটে ৬ নম্বর ওয়ার্ডও। এই ওয়ার্ডটি মহিলা (সাধারণ) হিসাবে সংরক্ষিত। এখানকার বিদায়ী কাউন্সিলর কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়ে কিছু সময়ের জন্য উপপুরপ্রধানের পদ পাওয়া রাজু ধীবর তাঁর স্ত্রীকে এ বার প্রার্থী করতে চাইছেন। কিন্তু অন্য দু’টি গোষ্ঠী চাইছে নয়না দত্ত ও গীতা ভকতকে প্রার্থী করতে। ৮ নম্বর ওয়ার্ড ঘিরেও দ্বন্দ্ব তুমুল। এখানে প্রার্থী হিসেবে উঠে এসেছে বিদায়ী কাউন্সিলর নিমাই বাউরির নাম। তাঁকে চাইছেন বিদায়ী পুরপ্রধানও। কিন্তু বাদ সেধেছে অন্য একটি গোষ্ঠী। দল সূত্রের খবর, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রার্থী হতে না পারলে ৮ নম্বরে প্রার্থী হতে চাইছেন ৭ নম্বরের বিদায়ী কাউন্সিলর দীনেশ শুক্ল। আবার তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের নেতা ৪ নম্বরের টিকিট না পেলে ৮-এ দাঁড়াতে চাইছেন।
ঘটনা হল রঘুনাথপুরে তৃণমূলের অভ্যন্তরের রাজনীতি বর্তমানে যে অবস্থায় পৌঁচেছে তাতে সর্বসম্মত প্রার্থী করা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল সূত্রেই খবর, ক্ষমতা ধরে রাখার আশা নিয়ে রঘুনাথপুরে তিনটি গোষ্ঠী পুরনির্বাচনের পরে বোর্ড গঠনের দিতে তাকিয়ে যতটা সম্ভব বেশি সংখ্যায় নিজেদের অনুগামীদের প্রার্থী করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তবে দলের তরফে পুরসভার দায়িত্বে থাকা রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি অবশ্য বলছেন, “কোনও রকম দ্বন্দ্ব নেই। আমরা বুথস্তর থেকে সর্বসম্মত ভাবে প্রার্থী স্থির করতে চাইছি। যিনি প্রার্থী হবেন এলাকায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও জেতার সম্ভবনা কতটা রয়েছে তা দেখা হচ্ছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy