Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পতিত জমিতে ফলল সব্জি, বদল এল স্বাদে

ভাতের সঙ্গের তরকারি বলতে এত দিন ওরা জানতেন পেঁপে কিংবা আলু। প্রোটিন বলতে জুটেছে গুগলি কিংবা চুনোমাছ। দিনের পর দিন একই খাবার খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেলেও কিছু করার ছিল না। কারণ সকলেরই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার।

খেতের পরিচর্যা। লাভপুরের জামনা পঞ্চায়েতে।— সোমনাথ মুস্তাফি

খেতের পরিচর্যা। লাভপুরের জামনা পঞ্চায়েতে।— সোমনাথ মুস্তাফি

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:০৮
Share: Save:

ভাতের সঙ্গের তরকারি বলতে এত দিন ওরা জানতেন পেঁপে কিংবা আলু। প্রোটিন বলতে জুটেছে গুগলি কিংবা চুনোমাছ। দিনের পর দিন একই খাবার খেতে খেতে পেটে চড়া পড়ে গেলেও কিছু করার ছিল না। কারণ সকলেরই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসার। মাস ছয়েকের চেষ্টায় সেই ছবিটাই পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন তনুশ্রী মণ্ডল, অনিমা দাসরা। এলাকার প্রায় পনেরোশো মহিলা বাড়িতে সব্জিবাগান করে রসনার স্বাদ বৈচিত্র্য ফিরিয়েছেন। পরিবারের সমৃদ্ধিও ফিরেছে তার দৌলতে।

এই পট পরিবর্তনের পিছনে ব্লক প্রশাসনের অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ২০০৮ সালে লাভপুরের জামনা পঞ্চায়েত এলাকার ১৪৩টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ১,৪৩০ জন সদস্যাকে নিয়ে গড়ে ওঠে ‘জামনা নিত্য সঙ্ঘ’। গত বার ওই সঙ্ঘের দফতরে রাখিবন্ধন উৎসবে যোগ দেন লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস। সদস্যাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানতে পারেন প্রায় সকলেরই ভাতের সঙ্গে খান তরকারি পেঁপে, আলু আর কলমির শাক। রোজ রোজ একই তরকারি দিয়ে ভাত খেতে আপনাদের ভাল লাগে? ওই মহিলাদের এই প্রশ্ন করতেই কার্যত অস্বস্তিতে পড়ে যান বিডিও। কারণ তাঁরা একযোগে বলে ওঠেন, ‘‘কী করব স্যার! আমাদের যে সব্জি কিনে খাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই।’’

সঙ্ঘের দফতরে বসেই উপায় ভাবতে থাকেন বিডিও। পথও বেরোয়। কথা বলে জানা যায় প্রায় সকলেরই বাড়িতে কমবেশি জমি অনাবাদী হয়ে পড়ে রয়েছে। যাঁদের নেই, তাঁদেরও অন্যের থেকে লিজ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেই দিনই পঞ্চায়েত কর্তাদের ডেকে ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে পতিত হয়ে পড়ে থাকা ওই সব জমি সমতল করার জন্য প্রকল্প তৈরির নির্দেশ দেন। কী করে অল্প জমিতে একই সঙ্গে ‘সঙ্গী-ফসল’ হিসাবে অন্য সব্জির চাষ করা যায়, কী ভাবে নিজেরাই জৈব ও তরল সার তৈরি করা যায়— লোককল্যাণ পরিষদের মাধ্যমে তার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। কৃষি উন্নয়ন দফতর থেকে মেলে বীজ-সহ অন্য সামগ্রী কেনার টাকা।

দ্রুত বদলাতে থাকে ছবিটা। মাস ছয়েক আগেও যেখানে ছিল ঝোপ জঙ্গল কিংবা আগাছায় ভরা পতিত ডাঙা, এখন সেখানেই কোথাও মাচা থেকে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে লাউ, কুমড়ো, ঝিঙ্গে, কেন্দুরীর মতো নানা সব্জি। সঙ্গী-ফসল হিসাবে মাচার নীচে দিব্যি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে আদা, হলুদ কিংবা ওল গাছ। আর ওই সব সব্জি বাগানই আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে মহিলাদের। স্বামী মনু মণ্ডলের দিনমজুরির আয়ে ভাতে অন্য সব্জি দূরের কথা, সংসারে খরচেই সংকুলান হতো না তনুশ্রীদের। পড়শির কাছ থেকে কাঠা চারেক জমি লিজে নিয়ে সব্জি বাগান করেছেন তিনি। নিজেদের পড়ে থাকা আট কাঠা জমিতে সব্জি বাগান করছেন ছবি ঘোষ। তাঁর স্বামী গঙ্গাধর ঘোষও দিনমজুর। প্রত্যেকেই বলছেন, ‘‘আগে আমরা ভাতে শুধু আলু আর পেঁপের তরকারি খেতাম। গুগলি কিংবা চুনোমাছের বেশি জুটত না। এখন নিজেদের বাগানের হরেকরকম সব্জি তো বটেই, উদ্বৃত্ত সব্জি বিক্রি করে মাঝে মধ্যে ডিম, মাছ, মাংসও কিনে খেতে পারি।’’

মহাসঙ্ঘের সভানেত্রী সুমিতা বাগদি, সম্পাদিকা অনিমা দাসরা জানান, শুধু স্বাদ বৈচিত্র্য ফেরানোই নয়, এলাকার অঙ্গনওয়াড়িকেন্দ্র, শিশুশিক্ষাকেন্দ্র এবং স্কুলের মিড-ডে মিলে উদ্বৃত্ত সব্জি বিক্রি করে তাঁরা ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া-সহ সংসারের ছোটখাটো খরচের সংস্থান করতে পারছেন। সবেতেই আর পুরুষদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘এত অল্প সময়ে জামনা পঞ্চায়েতের ওই মহিলারা এত ফসল ফলাতে পারবেন ভাবিনি। ওঁদের মডেল করে ব্লকের অন্য জায়গাতেও একই ভাবে সব্জিবাগান করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Farm land Vegetables Taste
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE