Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
জেলায় চরম সঙ্কটে কংগ্রেস

যোগ্য নেতৃত্বের অভাব

রাজ্যে পালা বদলের সাঙ্গে সঙ্গে হয়তো হারানো মাটি আবার ফিরে পাবে কংগ্রেস। এমনটাই আশা করেছিলেন জেলার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে কংগ্রেসের অনেক নেতাকর্মীই। কিন্তু বাস্তবটা একেবারেই উল্টো। শেষ পুরসভা নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ। চারটি পুরসভার মোট ৭৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র সাতটি আসন। অন্য দিকে, বিজেপি পেয়েছে ন’টি আসন। অথচ প্রবল বাম জামানাতেও জেলার পুরশহরগুলিতে কংগ্রেসের দাপট একরকম অটুট ছিল বলা যায়।

পতাকা বয়ে নিয়ে যাবে কে? জেলায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্ন। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

পতাকা বয়ে নিয়ে যাবে কে? জেলায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্ন। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়

ভাস্করজ্যোতি মজুমদার
সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৫ ০২:২২
Share: Save:

রাজ্যে পালা বদলের সাঙ্গে সঙ্গে হয়তো হারানো মাটি আবার ফিরে পাবে কংগ্রেস। এমনটাই আশা করেছিলেন জেলার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে কংগ্রেসের অনেক নেতাকর্মীই। কিন্তু বাস্তবটা একেবারেই উল্টো। শেষ পুরসভা নির্বাচনের ফলাফলই তার প্রমাণ। চারটি পুরসভার মোট ৭৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র সাতটি আসন। অন্য দিকে, বিজেপি পেয়েছে ন’টি আসন। অথচ প্রবল বাম জামানাতেও জেলার পুরশহরগুলিতে কংগ্রেসের দাপট একরকম অটুট ছিল বলা যায়। মাঝে এক-দু’বার রামপুরহাট ও দুবরাজপুর পুরসভা বামফ্রন্টরা দখল করলেও তা পরের নির্বাচনে ফের কংগ্রেস দখল করেছে। আর বাকি সাঁইথিয়া, নলহাটি, সিউড়ি ও বোলপুর পুরসভা বরাবরই কংগ্রেসের দখলে ছিল। এ ছাড়াও রামপুরহাট মহকুমা এলাকার রামপুরহাট, নলহাটি ও মুরারইয়ের গ্রামীণ এলাকাতেও কংগ্রেসের শক্তি বা সংগঠন ছিল জেলার বাকি অংশের চেয়ে অনেকটায় মজবুত। এগুলি বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর বিগত ২০-২৫ বছরের কথা। জেলা কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘এই মুহূর্তে চরম সঙ্কটে জেলা কংগ্রেস। সেই পতনের শিকড় এই জেলায় এত গভীরে পৌঁছে গিয়েছে যে, আর কিছুদিন বা কয়েক বছর পর দূরবীন দিয়েও দেখা যাবে না। যদি না এখনই সঠিক নেতৃত্ব বা সংগঠন নিয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তা শুরু না করা হয়।’’

বর্তমানে সমস্ত পুরসভাগুলিই একদা কংগ্রেসের জোটসঙ্গী তৃণমূলের দখলে। পুর নির্বাচন হওয়া সিউড়ি, সাঁইথিয়া, বোলপুর ও রামপুরহাট বাদ দিলে দুবরাজপুর ও নলহাটি শাসকদলের দখলে। ২০১৩র দুবরাজপুর পুর নির্বাচনে ১৬টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৯, কংগ্রেস ৪, বিজেপি ২, সিপিএম ১টি করে আসন পেয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যে কংগ্রেসের চার কাউন্সিলর দল বদল করে তৃণমূলে যোগ দেন। দুবরাজপুর এখন কংগ্রেস শূন্য। ২০১২ সালে নলহাটি পুর নির্বাচনে ১৫টি আসনের মধ্যে তৃণমূল ৮, কংগ্রেস ৩, বামফ্রন্ট ৩ (সিপিএম ১, ফব ১, বাম সমর্থিত নির্দল ১) ও বিজেপি ১টি আসন দখল করে। পরে বাম সমর্থিত নির্দল ও সিপিএমের এক কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূল আট থেকে বেড়ে দশ হয়। অথচ এই নলহাটি পুরসভাতেও কংগ্রেসের একতরফা আধিপত্য ছিল প্রথম নির্বাচন থেকেই। ২০১২ ও ২০১৩ নলহাটি ও দুবরাজপুর পুর নির্বাচনের আগে দু’টি পুরসভার শাসক কংগ্রেস সদলবলে তৃণমূলে যোগ দেয়। স্বাভাবিক ভাবেই বোর্ড তৃণমূলের দখলে চলে যায়। একই ঘটনা ঘটে সাঁইথিয়া-সহ অন্যান্য পুরসভাগুলির ক্ষেত্রেও।

স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক মহল থেকে সাধারণ মানুষ জনের মধ্যে একটা প্রশ্ন দিন দিন প্রকট হচ্ছে, দলটায় কী অভাব? যার কারণে প্রাচীন এই দলটি ছেড়ে সকলে শাসকদলে নাম লেখাচ্ছেন? ওই দল বদলে শুধু পুর-কাউন্সিলররাই আছেন তা নয়, এই তালিকায় আছেন কংগ্রেসের প্রাক্তন জেলা সভাপতি তথা বামফ্রন্টের সঙ্গে সমানে লড়াই করে একাধিকবার হাঁসনকেন্দ্র থেকে জেতা অসিত মাল, রাজ্যের অন্যতম কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিউড়ির দাপুটে বিধায়ক সুনীতি চট্টরাজ, জেলা কংগ্রেসের নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী মুরারইয়ের প্রয়াত মোতাহার হোসেন, বোলপুরের প্রাক্তন বিধায়ক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়, বর্তমান শাসকদলের সাসপেন্ড হওয়া সিউড়ির বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ-সহ অনেকেই। তালিকায় আরও আছেন। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনের অনেক জয়ী, থেকে জেলার ছোট বড় মাঝারি সমস্ত স্তরের নেতা কর্মীরা দল বদল করে তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন। পরে অনেকেই আবার শাসক দলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। ফিরে এসেছেন কংগ্রেসে।

এই ফিরে আসার তালিকার উল্ল্যেখযোগ্য নাম মোতাহার হোসেন, সুনীতি চট্টরাজ, সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ছোট বড় অনেকেই থাকতে পারেন। ফের কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন এমনও কেউ কেউ আছেন, যেমন সুনীতিবাবু। এই দল বদলের পিছনে কী যোগ্য নেতৃত্বের অভাব? না কি অন্য কিছু? জেলা কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, ‘‘যোগ্য নেতৃত্বের অভাব তো নিশ্চই আছে। আজকের দিনে যে পদ্ধতিতে রাজনীতি করা বা আন্দোলন গড়ে তোলা উচিৎ কংগ্রেস তা পারছে না। কারণ, সত্যি বলতে আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করার মতো যোগ্য নেতা এই মুহূর্তে জেলা কংগ্রেসে নেই। পাশাপাশি অনেকে আবার সহজে ক্ষমতা ভোগের লোভে দল বদলে শাসক দলে নাম লেখাচ্ছেন। আবার অনেকে দল ছেড়েছেন কিছু নেতার খামখেয়ালিপনা ও পক্ষপাতিত্বের জন্য। আবার কেউ কেউ গেছেন আখের গোছাতে এবং কোন কাজ বা কিছু পাওয়ার আশায়।’’

দলের এআইসিসি’র সদস্য সুশোভনবাবু বলেন, ‘‘প্রথমত তৃণমূলে যাওয়ার বিষয়টি একেবারে কাকতালীয়। ১-১-১৯৯৮ একটি সভায় হঠাৎ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁকে নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠিত হল। ওখানেই তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের বীরভূম জেলা সভাপতি হিসেবে আমার নাম ঘোষণা করেন। কিন্তু ওঁদের সংস্কৃতির সঙ্গে আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারিনি। তাই বছর দেড়েক পর ছেড়ে ফের কংগ্রেসে যোগ দিই।’’ দলের হাল সম্পর্কে কোনও রাখঢাক না রেখেই তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জেলার অস্তিত্বও চরম সঙ্কটে। তার প্রধান কারণ, অবশ্যই যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। পাশাপাশি ক্ষমতার লোভ, আখের গোছানো থেকে শাসক দলের চোখ রাঙানির ভয় এ সব তো আছেই। আর তার চেয়েও বড় কথা হল বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন তাঁদের আমাদের নেতাকে বলতে শোনা যেত, মমতা অতি বাম। রাজ্যের মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন অতি বামের সংজ্ঞা কী।’’ তিনি তৃণমূল ও সিপিএমকে আক্রমণ করে বলেন, ‘‘বাম আমলে গণতন্ত্র ছিল না বললেই চলে। অধিকাংশ যায়গায় কার্যত নির্বাচন হত না। আর এই অতি বাম তৃণমূল সরকারের শাসনকালে কার্যত কোথাও নির্বাচন হয় না। এই অতি বামের সঙ্গে লড়াই করার জন্য লড়াকু নেতা ও যুব শক্তির প্রয়োজন। তা না হলে এই জেলা বা রাজ্যে ঘুরে দাঁড়ানো যথেষ্ট শক্ত। ছোটছোট পকেট করে আন্দোলন করতে হবে।’’ কেমন সেটা? তিনি বলেন, ‘‘যে সব অফিস যেমন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতরর, থানা, প্রশাসন ভবন, পুরসভা, পঞ্চায়েত ইত্যাদি যে সব স্থানে সাধারণ মানুষকে পরিষেবার জন্য নানা ভাবে হয়রানির শিকার হতে হয় সে সব স্থানে মানুষের স্বার্থে যদি আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, তবেই জেলা বা রাজ্যে কংগ্রেস ফিরে আসবে।’’

জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মি অবশ্য এই জেলায় কংগ্রেসের অস্তিত্ব সঙ্কট মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘‘কংগ্রেস এ বারের পুর নির্বাচনে ৯০ শতাংশ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। সাতটা আসন পেয়েছে। অধিকাংশ আসনের প্রার্থীরা লড়াইয়ে ছিলেন। শুধু সাঁইথিয়া বাদে।’ উল্ল্যেখ যোগ্য ফল না হওয়ার কারণ, সর্বত্র বিশেষ করে সাঁইথিয়াতে চরম ছাপ্পা ভোট ও অর্থের খেলা এবং হুমকি থেকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখানো হয়েছিল। আন্দোলন গড়ে তোলা হচ্ছে। আশা করছি ছোট ছোট আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেস আবার তার আসন পুনরুদ্ধার করবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE