শিল্পের জন্য জমি কিনে কেউ ফেলে রেখেছিলেন। কেউ বা কলকারখানা চালু করলেও পুরো জমি ব্যবহার করছিলেন না। ফেলে রাখা সেই সব জমিতেই এ বার ফলতে চলেছে আলু, পেঁয়াজ, কপি, ওল, পেঁপের মতো সব্জি।
বাঁকুড়া জেলা উদ্যানপালন দফতরের ডাকে চাষিদের পাশাপাশি কিছু শিল্পদ্যোগীও সব্জি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কেউ কেউ চাষাবাদ শুরুও করে দিয়েছেন। তবে শুধু সব্জি বিক্রি করে মুনাফা তোলাই নয়, সরকারি ভর্তুকিরও সম্ভাবনা থাকায় শিল্পোদ্যোগীদের অনেকেই তাঁদের ফেলে রাখা জমিতে ধীরে ধীরে সব্জি চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। প্রশাসনিক পরিভাষায় একে বলা হচ্ছে ‘কৃষি-শিল্প’। ভারী শিল্পের পাশাপাশি হাতে থাকা ব্যক্তিগত জমিতেও কৃষি ভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী হচ্ছেন বাঁকুড়ার বহু উদ্যোগপতি।
প্রশাসন সূত্রের খবর, সব্জি চাষে বড় পরিমাণ ভর্তুকি ও সুবিধা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার। সেই সংক্রান্ত খোঁজখবর নিতেই বাঁকুড়ার বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগী জেলা উদ্যানপালন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। দফতরের আধিকারিকেরা তাঁদের বুঝিয়েছেন, কৃষি-শিল্পে আয়ের সুযোগ কতটা। জেলা উদ্যানপালন দফতরের আধিকারিক মলয় মাজির কথায়, “শিল্পপতিদের হাতে অনেক ব্যক্তিগত জমি রয়েছে। যা ব্যবহার না করে ফেলে রাখা হচ্ছে। আমাদের দফতরের সঙ্গে যে-সব শিল্পোদ্যোগী যোগাযোগ করেছেন, তাঁদের সকলকেই আমরা ফেলে রাখা জমি কৃষি-শিল্পের কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছি।’’
দফতরের আবেদনে সাড়া দিয়ে বেলিয়াতোড়ের একটি রেলের ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানার অন্যতম কর্ণধার শ্যামসুন্দর কেডিয়া লিখিত ভাবে উদ্যানপালন দফতরকে পড়ে থাকা জমিতে চাষ করার জন্য আবেদন জানান কয়েক মাস আগে। সেই আবেদনের প্রেক্ষিতেই জেলা উদ্যানপালন দফতর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। জেলার আরও বেশ কিছু ছোট-মাঝারি শিল্পোদ্যোগী নিজেদের হাতে থাকা জমিতে কৃষি-শিল্প গড়ার পরিকল্পনা শুরু করেছেন।
শ্যামসুন্দরবাবুর ব্যক্তিগত ৫৪ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ, বরবটি, ফুলকপি, ওল, পেঁপে-র মতো সব্জি লাগানো হয়েছে। পাশাপাশি কলা ও আমবাগান গড়ে তুলতেও চারা গাছ পুঁতে ফেলেছেন তিনি। ইতিমধ্যেই শ্যামসুন্দরবাবুর খেতের সব্জি বাজারে বিক্রি শুরু হয়েছে। তিনি জানান, বেলিয়াতোড়ে তাঁদের কারখানাটি সাড়ে পাঁচ দশক আগে গড়ে তোলা হয়েছিল। কারখানার জন্য প্রায় আট একর জমি নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী কালে আরও কয়েকশো বিঘা জমি ওই এলাকাতেই তাঁরা কিনে রেখেছিলেন ব্যক্তিগত ভাবে। যা ব্যবহার করা হচ্ছিল না। সেই অব্যবহৃত জমির একটা অংশই সব্জি চাষের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। শ্যামসুন্দরবাবু বলেন, “জেলায় চাহিদার তুলনায় সব্জির জোগান কম। উদ্যানপালন দফতর নানা সুবিধাও দিচ্ছে চাষের জন্য। ওই দফতরের কর্তাদের কথাতেই চাষ করার পরিকল্পা নিয়েছি।’’ তিনি জানাচ্ছেন, আপাতত পরীক্ষামূলক ভাবেই এই চাষ শুরু করেছেন। বাঁকুড়ার সুস্বাদু আম ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে গোটা দেশের। নিজের জমিতে আমবাগান গড়ার পরিকল্পনাও নিয়েছেন এই শিল্পোদ্যোগী।
সব্জি চাষে আগ্রহ দেখিয়ে জেলা উদ্যানপালন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বড়জোড়ার ঘুটগোড়িয়া শিল্পাঞ্চলের একটি ইস্পাত তৈরির কারখানার অন্যতম কর্ণধার অরুণ অগ্রবালও। উদ্যানপালন দফতরের কাছে অরুণবাবু তাঁর হাতে থাকা তিন একর অব্যবহৃত জমিতে সব্জি চাষ করার কথা জানান। দফতরের তরফে তাঁকে লিখিত ভাবে আবেদন জানাতে বলা হয়েছে। অরুণবাবুর কথায়, “স্টিল কারখানার বাজার এখন পড়তি। তুলনায় কৃষি-শিল্পে এই জেলায় ভাল লাভের সুযোগ রয়েছে। হতে পারে অনেক কর্মসংস্থানও। তাই হাতে থাকা অব্যবহৃত জমিতে কৃষি ভিত্তিক শিল্প গড়তে চাই।’’ উদ্যানপালন দফতরের ফিল্ড অফিসার সঞ্জয় সেনগুপ্ত জানান, বাঁকুড়ার বনকাটি ও বড়জোড়ার আরও কয়েকটি স্পঞ্জ আয়রন কারখানার মালিকেরা কৃষি-শিল্প গড়তে দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
জেলায় সব্জির চাহিদা দৈনিক গড়ে প্রায় ৪২ টন। সেখানে উৎপাদন হয় দৈনিক গড়ে প্রায় ২৯ টন। বাকি সব্জি আমদানি করতে হয় রাজ্যের ভিন জেলা থেকে। এখনও পর্যন্ত তিনজন শিল্পপতি জেলা উদ্যানপালন দফতরের কাছে সবজি চাষে আগ্রহ দেখিয়ে আবেদন করেছেন। যাঁর মধ্যে একজনশিল্পপতি ইতিমধ্যেই চাষ শুরু করে দিয়েছেন। উদ্যানপালন দফতরের প্রাক্তন রাজ্য উপদেষ্টা তথা রাজ্য অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশিস বটব্যাল বলেন, “জেলায় সবজি চাষের ঘাটতি মেটাতে চাষের পরিমান বাড়াতে হবে। শিল্পপতিরা যদি এগিয়ে আসেন তাহলে এক ধাক্কায় অনেকটাই উৎপাদন বাড়বে। তাঁদের হাতে অনেক ব্যক্তিগত জমি থাকে। সেই জমিতেই সব্জি চাষ করা আমাদের লক্ষ্য। শীঘ্রই এ বিষয়ে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে।’’
কৃষি ভিত্তিক শিল্পে কেন আগ্রহী হচ্ছেন শিল্পপতিরা?
বাঁকুড়া চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন দরিপার কথায়, “আয়করে ছাড় রয়েছে কৃষি-শিল্পে। এটা শিল্পোদ্যোগীদের কাছে অবশ্যই বাড়তি সুবিধা। সঙ্গে ব্যাপক আয়ের সম্ভাবনাও রয়েছে।’’ ভারী শিল্পের জন্য জমি কিনে শিল্প না গড়লে তিন বছর পরে সেই জমি সরকার ফিরিয়ে নেবে বলে আইন চালু করেছে তৃণমূল সরকার। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার বক্তব্য, “শিল্পের জন্য কেনা জমিতে তিন বছরের মধ্যে শিল্পই গড়তে হবে। কৃষির জন্য সেই জমি ফেলে রাখা হবে না।’’