Advertisement
E-Paper

স্বাদে সমঝোতা নয়, গাঁয়ের ভরসা ঢেঁকিই

ধুপ-ধাপ শব্দ ক্ষীণ হতে হতে স্মৃতিতে সেঁধিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। ঢেঁকিশালে ঢেঁকিই তো নেই! তবু সে আওয়াজ এখনও বাংলার যে যে অংশে ক্ষীণ হয়েও বেজে চলেছে, তার মধ্যে অন্যতম রাজনগর, খয়রাশোলের হাতেগোনা গ্রাম।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:৫৫
ঢেঁকি-ছাঁটা। —নিজস্ব চিত্র।

ঢেঁকি-ছাঁটা। —নিজস্ব চিত্র।

ধুপ-ধাপ শব্দ ক্ষীণ হতে হতে স্মৃতিতে সেঁধিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। ঢেঁকিশালে ঢেঁকিই তো নেই!

তবু সে আওয়াজ এখনও বাংলার যে যে অংশে ক্ষীণ হয়েও বেজে চলেছে, তার মধ্যে অন্যতম রাজনগর, খয়রাশোলের হাতেগোনা গ্রাম।

বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে মকরসংক্রান্তির আগে রাজনগরের বান্দি গ্রামে দেখা মিলল ঢেঁকির। রাজনগরের এই গ্রামে ৮০ পরিবারের বাস। তল্লাটে রয়েছে দুটি ঢেঁকি। তাতেই চাল ছাঁটেন স্থানীয়েরা। প্রৌঢ়া সুভদ্রা ঘোষদের বাড়ির ঢেঁকিতে পিঠে তৈরির জন্য চাল-গুঁড়ো করতে এসেছিলেন সলি, সন্তোষী, উর্মিলা মালেরা। জানালেন, দু’দশক আগে গ্রামে গম ভাঙানো মেশিন বসেছে। সেখানেই চালের গুঁড়ো মেলে। কিন্তু, তাতে পিঠের স্বাদ খোলে না। তাই আসেন ঢেঁকি ছাঁটা চাল নিতে।

সম্প্রতি পানাগড়ের মাটি উৎসবে শুরু হয়েছে ঢেঁকির দ্বিতীয় ইনিংস। এই উৎসবের প্রথম কারণ যদি হয় কর্মসংস্থান, দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই ঢেঁকি-ছাঁটা চাল। সেই স্বাদের টানেই কষ্ট করে হলেও সুভদ্রাদেবীদের বাড়িতে আসেন স্থানীয়েরা। সুভদ্রাদেবী জানালেন, এখন শুধু চৈত্র মাসে ছাতু, নবান্নের সময় ও পৌষ মাসে ঢেঁকির ব্যবহার হয়। পাড়ার মেয়ে-বৌয়েরা এসে নিজেরাই চাল ছেঁটে যাওয়ার সময় ৫, ১০ টাকা করে দেয়। অভাবের সংসারে সেটুকুই সম্বল। গ্রামের প্রদীপ রায়দের বাড়িতে রয়েছে ১০০ বছরের পুরনো ঢেঁকি। সেখানেও চাল গুঁড়ো করতে আসেন পাড়ার মহিলারা। টাকাপয়সা নেন না প্রদীপবাবুরা। লতিকা দাস, সরমা রায়, স্বপ্না দাসেরা বলছেন, ‘‘মেশিনে চালের গুঁড়োয় পুরভরা পিঠে হতে পারে। কিন্তু চিকুলি-র (পাতলা জনপ্রিয় পিঠে) জন্য ঢেঁকি চাই।’’ প্রদীপবাবুর স্ত্রী রাধারানি রায়ের কথায়, ‘‘বাড়িতে যখন ঢেঁকি আছে, তখন গ্রামের মানুষ কেন ব্যবহার করবেন না! শর্ত একটাই, পৌষের সন্ধ্যায় চাল গুঁড়ো বাড়িতে নিয়ে যেতে দিই না। লক্ষ্মী বলে কথা।’’

খয়রাশোলের বুধপুর ও হরিপুর নামে দুটি মুসলিম প্রধান এলাকাতেও রয়েছে ঢেঁকি। এখানকার পরিবারগুলি অগ্রহায়ণের নতুন ধান উঠার পর থেকেই তৈরি করে এক ধরনের ভাপ দেওয়া পিঠে, নাম ধুকি। ঢেঁকিতে করা চালের গুঁড়ো থেকে ভাপ দিয়ে তৈরি অনেকটা ইডলির ধাঁচে তৈরি করা হয় পিঠে। হরিপুর গ্রামের নুরনেহার বিবি, বুধপুরের সামিয়ানা বিবি, আলেফা বিবিদের কাছে থেকে সকাল হলেই সেই পিঠে ১৫ টাকা প্রতি পিস কিনে নিয়ে যান গ্রামের মানুষ। নুরনেহার বিবির কাছ থেকে পিঠে তৈরি শিখেছেন মেয়ে সরিফা বিবিও। বলছেন, ‘‘ভোর চারটে থেকে পিঠে করি। দিনে ১৫-২০টার বেশি তৈরি করা যায় না। আর ঢেঁকি ছাড়া তো করাই যায় না।’’ ওই পরিবারগুলির জন্য ছোটরা পিঠের স্বাদ পায়, জানাচ্ছেন গ্রামেরই সফিয়া বিবি, আফিজা বিবিরা।

আর ঢেঁকি-ছাঁটা চালের খাদ্যগুণ?

কৃষি বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ঢেঁকি-ছাটা এক কাপ চালে প্রায় ১১০ ক্যালোরি শক্তি মেলে। সেখানে সম পরিমাণ চালকলের চালে মেলে ৮০ থেকে ১০০ ক্যালরি। ঢেঁকি-ছাঁটা চালে চার ধরনের ভিটামিন এবং অন্য নানা খাদ্যগুণ রয়েছে বেশি পরিমাণে। কিন্তু দামটাও বেশি। শহরের বড় বিপণিতে গড়ে ১১০-১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয় এই চাল। চাহিদাও সীমিত।

‘‘দু’টো চালের তুলনাই চলে না’’— বলছিলেন এক প্রবীণ। তাঁর কথায়, ‘‘এখনকার মেশিনে পেষাই করা গুড়ি কেমন যেন আঠা-আঠা, পোড়া-পোড়া লাগে। কিন্তু, ঢেঁকিছাঁটা চালগুড়ির নবান্নের স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে। সে কি ভোলার!’’

Dheki Pithe
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy