দিনের আর রাতের বোলপুরের মধ্যে তফাৎ কোথায়?
রসিকে বলে, ‘‘রাতের বোলপুরে গাড়ির লাইন নেই, ধোঁয়া নেই, আওয়াজ নেই— সাইকেলে চেপে দিব্য এ প্রান্ত ও প্রান্ত ঘোরা যায়। রাস্তায় বসে হাইমাস্কের আলোয় আপন মনে মর্জি মতো ছবি আঁকা যায়। দিনে বোলপুরে যা আকাশকুসুম বিলাস মাত্র!’’
আর, ভুক্তভোগী বলে, ‘‘রাতের বোলপুর তো যন্ত্রণার আর এক নাম! আতিপাতি করে খুঁজেও ওষুধের দোকান খোলা পাওয়া যাবে না। বিপদে পড়লে পুলিশের দেখা মিলবে না। টোটো থেকে রিকশা নির্দিষ্ট ভাড়ার চেয়ে চার, পাঁচ গুণ বেশি টাকা চাইবে।’’
বৃহস্পতিবার রাতের বোলপুরে ওঠে এল দু’রকম ছবিই। কেমন?
তখন ৮০
তখন রাত দেড়টা। আপ কবিগুরু এক্সপ্রেস থেকে বোলপুর নেমে রিকশার খোঁজ করছিলেন শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গৃহবধূ বাসন্তী মাহাতো। সঙ্গে ছিল বছর আঠারোর ছেলে মুকেশ। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে তাঁরা রিকশার খোঁজ করছিলেন। কিছু পরে দেখা গেল রিকশা বা টোটোয় না উঠে হন্হন্ করে হাঁটতে শুরু করেছেন। রিকশা নিলেন না? একরাশ বিরক্তি উগরে বাসন্তীদেবী বলেন, ‘‘যে পথ যেতে টোটোয় দশ টাকা আর রিকশায় ২০ টাকা লাগে সেখানে এখন ৮০ টাকা চাইছে! কিছুটা বেশি দেওয়াই যায় তাই বলে এত বেশি?’’ বলেই দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি।
রাতের বোলপুরে এসে পৌঁছয় একাধিক ট্রেন। লোকমান্যতিলক-কামাক্ষা কর্মভূমি এক্সপ্রেস, দার্জিলিং মেল, শিয়ালদহ-দিল্লি এক্সপ্রেস ইত্যাদি। তা থেকে একেবারে কম যাত্রী নামেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বেশ কয়েকগুণ ভাড়া দিয়ে তবেই গন্তব্যস্থলে যেতে হয় আগন্তুককে। চলে জোর দর কষাকষিও। স্টেশন লাগোয়া কালিপুকুর এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন ভিন রাজ্যের বাসিন্দা সুলোচনা সাহানি। স্টেশন থেকে দশ, বিশ টাকা ভাড়া বলেই জানতেন। ৮০ টাকা শুনে সুলোচনাদেবী অবাকও। কোন মতে পঞ্চাশ টাকায় রাজি করিয়ে চেপে বসলেন রিকশায়। সুলোচনাদেবীর স্বগোতোক্তি, ‘‘রাতবিরেতে বলে কথা। দেওয়া ছাড়া উপায় কি?’’
কেন বেশি ভাড়া?
টোটো চালক মুকেশ চক্রবর্তী, রিকশা চালক ননীগোপাল সরকারেরা বললেন, ‘‘মাঝ রাতে ফেরার ভাড়া পাব কোথা থেকে? তাই দশ-বিশ টাকা বেশিই নেওয়া হয়।’’ এ কথা অবশ্য মেনেছেন রিকশা ইউনিয়নের নেতারাও।
নেই ওষুধ
স্টেশন মোড় থেকে ফেরার পথে দেখা মিলল দুই মোটরবাইক আরোহীর। নির্জন রাস্তায় এই প্রতিবেদকের কাছেই তাঁরা জানতে চাইলেন, ‘‘দাদা, ওষুধের দোকান কোন দিকে বলতে পারেন?’’ আরও জানালেন, সামান্য প্যারাসিটামলও হন্যে হয়ে খুঁজে পাননি তাঁরা। স্থানীয় সূত্রের খবর, রাত ন’টার পর থেকেই ওষুধের দোকান বন্ধ হতে শুরু করে। দশটার পরে বোলপুর শহরে কোনও দোকানই খোলা থাকে না। একমাত্র ওষুধ মেলে মহকুমা হাসপাতালের কাছে। সামান্য জ্বরজ্বালা থেকে দুর্ঘটনা— যেতে হয় সেখানেই।
মাসখানেক আগে বোলপুরে ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন মহকুমাশাসক, মহকুমা পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা। সেখানে রাতভর ওষুধের দোকান খোলা রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। ব্যবসায়ী সংগঠনের তরফে সম্মতিও দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, তারপরেও কাজ এগোয়নি একটুকুও।
পুলিশ কই?
পুর শহরের বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, রাতের বোলপুরে গত কয়েক মাসে বড়সড় চুরি, ছিনতাই বা তেমন কোনও বড় অপরাধের নজির নেই ঠিকই। কিন্তু, হতে কতক্ষণ? সে আশঙ্কা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল রাতের বোলপুরে। রাত দশটা থেকে তিনটে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বোলপুরের প্রধান রাস্তাগুলি দিয়ে চলাফেরার পরেও পুলিশের দেখা মিলল না। অথচ এখানেই রয়েছে মহকুমাশাসকের দফতর, শ্রীনিকেতন-শান্তিনিকেতন উন্নয়ন পর্ষদ আরও কত কি গুরুত্বপূর্ণ দফতর। রয়েছে অজস্র ট্যুরিস্ট লজ, হোটেল। আনাগোনা রয়েছে পর্যটকের। শহরবাসীর অনেকেরই প্রশ্ন, ‘‘এমন জায়গায় উর্দিধারীর দেখা না পাওয়াই তো অস্বাভাবিক!’’ নজরে এসেছে বহু রক্ষীবিহীন এটিএমও। বোলপুর থানার পুলিশ অবশ্য তেমনটা মানতে চায়নি।
ক্ষীণ আলো
কাশিমবাজার, শুঁড়িপাড়া, বাইপাস এবং শ্রীনিকেতন রাস্তার ধার ধরে চলতে চলতে দেখা গেল ইতিউতি জ্বলছে ক্ষীণ আলো। কোথাও জ্বলছে মোবাইল টর্চ। ভেসে আসছে ফিসফাস শব্দ। কারা ওখানে? স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, রাতের আধারে পুলিশের অনুপস্থিতিতে চলে নেশার নানা ঠেক। মাঝ রাতে বাড়ি ফেরছিলেন ওই এলাকার এক যুবক। তিনি জানালেন, মদ-গাঁজা তো বটেই আরও নানা নেশা করা হয় ওই সব ঠেকে। এমন ছবি তাঁদের নজরে আসেনি বলে দাবি করেছেন বোলপুরের পুলিশ কর্তারা। তবে, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা পুলিশের এক কর্তা।
অবশেষে
তখন রাত ৩টে। শ্রীনিকেতন বাজারে চার মাথার কাছে দেখা মিলল পুলিশের দু’দুটি গাড়ির। তাঁরা অবশ্য দাবি করলেন, রাতভর টহল দিচ্ছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখে সমস্যাগুলি সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন বোলপুরের পুরপ্রধান সুশান্ত ভকত। রাতের বেলায় কেন পুলিশের নজরদারি কম, সে বিষয়ে বীরভূমের পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমারকে ফোন, এসএমএস করা হলেও তিনি কোনও উত্তর দেননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy