Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
bankura

History: বর্গি হানার স্মৃতিচিহ্ন, নাকি সাহেবি স্তম্ভ, বাঁকুড়ায় ‘লাল দুর্গের’ গায়ে অবহেলিত ইতিহাস

নেহাত ল্যান্ডমার্কের বাইরে আজও পরিচিতি গডে় ওঠেনি বাঁকুড়ার ইতিউতি অবহেলায় দাঁড়িয়ে থাকা মাচানগুলির।

ইতিহাস বুকে নিয়ে এ ভাবেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাচানগুলি।

ইতিহাস বুকে নিয়ে এ ভাবেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাচানগুলি। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ০৪ অগস্ট ২০২১ ১৯:৫১
Share: Save:

লালমাটির দু’পাশে সবুজের সমারোহ। তার মধ্যেই কয়েক মাইল ছাড়া ছাড়া মাথা তুলে দাঁড়িয়ে তারা। একঝলক দেখলেই চোখ আটকে যায়। হাঁটতে হাঁটতে থমকে যান পর্যটকেরা। কিন্তু সদুত্তর মেলে না। কারও কাছে সেগুলি লাল দুর্গ, কারও কাছে গির্জা। তবে মাচান হিসেবেই বেশি পরিচিত। যুগ যুগ ধরে সেগুলি দেখে আসছেন ছেলে-বুড়ো সকলেই। নানা কাহিনিও শুনেছেন। কিন্তু নেহাত ল্যান্ডমার্কের বাইরে আজও পরিচিতি গডে় ওঠেনি বাঁকুড়ার ইতিউতি অবহেলায় দাঁড়িয়ে থাকা মাচানগুলির।

বাঁকুড়ায় পা রাখলে, কয়েক মাইল দূরে দূরেই এই মাচান চোখে পড়তে বাধ্য। কোথাও ঝোপঝাড়ের মাঝে কোনও রকমে মাথা উঁচু করে, কোথাও আবার লোকালয়ে ঘুঁটের দেওয়াল হয়ে বুক পেতে, কোথাও আবার পাতাবিহীন ঢ্যাঙা তালগাছের মতো গড়ন তার। দেখে দেখে চোখ সয়ে গিয়েছে বলে তাদের নিয়ে তেমন গরজ নেই স্থানীয়দের। কিন্তু লালমাটির গন্ধ মাখতে যাওয়া পর্যটকদের চোখ টেনে নেয় তারা।

অহল্যাবাঈ রাস্তা ধরে এগোলে কিছুটা অন্তর অন্তর ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু এমনই মাচান চোখে পড়ে। নোনা ধরে যাওয়া ইটের গাঁথনি। গোল মিনারের মতো দেখতে স্তম্ভ। কিন্তু ভিতরটা ফাঁপা। নীচের দিকে ব্যাস প্রায় ২০ ফুট। উচ্চতা যত বেড়েছে, ততই কমেছে স্তম্ভের ব্যাস। তার মধ্য দিয়েই গোল রুটির মতো একটু আকাশ দেখা যায়। স্থানীয়দের দাবি, উপরে ওঠার জন্য এক সময় স্তম্ভের ভিতর প্যাঁচানো সিঁড়িও ছিল। এখন আর তার অবশিষ্ট নেই। তবে ভিতরে পড়ে থাকা ইঁট-সুরকির স্তূপ তার জানান দেয়। স্তম্ভের গায়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর পূর্ব-পশ্চিমে জানলাও রয়েছে।

বাঁকুড়ার বাসুদেবপুর জঙ্গল, ওন্দা ব্লকের চৌকিমুড়া, ছাতনা ব্লকের ছাতনা এবং আড়রা গ্রামের এখনও চারটি মাচান মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গবেষকদের একাংশের দাবি, একসময় বাঁকুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্রেও একটি মাচান ছিল। ব্রিটিশ আমলে তার উপরের অংশ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে। পরবর্তী কালে তার উপরই জলের ট্যাঙ্ক বসানো হয়। তার জন্যই এলাকার নাম মাচানতলা। তবে অবশিষ্ট মাচানগুলির অধিকাংশেরই জীর্ণ দশা। খসে পড়ছে ইঁট-সুরকি। গায়ে বড় বড় ফাটল। তার মধ্য দিয়ে বেরিয়েছে বট-অশ্বত্থ গাছ। কোথাও লতাপাতায় মাচানের নীচের দিকের পুরোটাই ঢেকে গিয়েছে। কোথাও আবার আবার যত দূর হাত যায়, তত দূর ঘুঁটে দিয়ে রেখেছেন স্থানীয়রা।

এই মাচানের ইতিবৃত্ত স্থানীয়দের কেউই ঠিক জানেন না। অনেকের মতে, মাচানগুলি বাংলায় বর্গি আক্রমণের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। তাঁদের যুক্তি, সুউচ্চ এই মাচানগুলিতে এক সময় মোতায়েন থাকত মল্ল রাজাদের সেনা। উপর থেকে এলাকা নজরদারি চালাত তারা। বর্গি সেনা দেখতে পেলেই সতর্ক করত মল্ল রাজত্বের সুদক্ষ বাহিনীকে। গবেষকরা যদিও এই যুক্তি মানেন না। তাঁদের দাবি, বর্গি আক্রমণের সঙ্গে মাচানগুলির কোনও সম্পর্ক নেই। সেগুলি আসলে সিমাফোর টাওয়ার, যার মাধ্যমে সঙ্কেতের মাধ্যমে গোপন তথ্য পৌঁছে দেওয়া হত।

গবেষকদের যুক্তি, টেলিগ্রাফ আবিষ্কার হওয়ার আগে উনিশ শতকের একেবারে গোড়ায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম থেকে চুনার দুর্গ পর্যন্ত এমন বেশ কয়েকটি স্তম্ভ ছিল। সাঙ্কেতিক পদ্ধতিতে তথ্য আদান প্রদানের জন্যই সেগুলি তৈরি করে ব্রিটিশরা। কিছুটা দূর দূর অবস্থিত এই স্তম্ভে উঠে পতাকার সাহায্যে বিশেষ সাঙ্কেতিক চিহ্ন তুলে ধরে পরের স্তম্ভের কর্মীদের বার্তা দেওয়া হত। সেখান থেকে টেলিস্কোপে চোখ রেখে তা বুঝে নিতেন ব্রিটিশ সরকারের কর্মীরা। তাঁরাও একই ভাবে পরের স্তম্ভে বার্তা পৌঁছে দিতেন। এ ভাবেই দূরবর্তী স্থানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দেওয়া হত। কিন্তু সার্বিক ভাবে এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার আগেই টেলিগ্রাফ অবিষ্কার হয়ে যায়। ফলে মাঝপথে এই প্রকল্প বন্ধ করে দেয় ব্রিটিশরা।

কিন্তু এই মাচানের ইতিহাস যাই হোক না কেন, সেগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অস্বীকার করতে নারাজ গবেষকরা। বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তথা লোক গবেষক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রাচীন তথ্য প্রযুক্তির এক অনন্য দলিল এই মাচানগুলি। ২০০ বছর পুরনো এই মাচানগুলি সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই নেই। সংরক্ষণ করা হলে, এক দিকে যেমন পর্যটনের বিকাশ হত, তেমনই প্রাচীন সিমাফোর প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে পারত নতুন প্রজন্ম।’’ মাচানগুলি সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। ছাতনার বাসিন্দা অরিন্দম মুখোপাধ্যায় এবং সুদেব ঘোষ বলেন, ‘‘রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়ার পথে এই মাচান দেখে বহু পর্যটক আগ্রহ দেখান। কিন্তু এই মাচানগুলি সম্পর্কে সঠিক তথ্য স্থানীয়রা অনেকেই দিতে পারেন না। এই মাচানগুলি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ করা হলে এলাকার পর্যটনের আরও বিকাশ ঘটত।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tourism History bankura negligence British Era
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE