Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
পাঁচশো-হাজারের নোটে জমা নয়

নতুন নির্দেশে বিপাকে চাষিরা, দাবি সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তাদের

নোট বাতিলে এমনিতেই বেসামাল জনজীবন। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। রোজের সংসার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে সাধারণ চাষি, দিনমজুর, ছোট দোকানিদের। কাছেপিঠে ব্যাঙ্ক বা এটিএম না থাকায় চরম ফাঁপরে তাঁরা।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১৯
Share: Save:

নোট বাতিলে এমনিতেই বেসামাল জনজীবন। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে এর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। রোজের সংসার চালানোই মুশকিল হয়ে পড়েছে সাধারণ চাষি, দিনমজুর, ছোট দোকানিদের। কাছেপিঠে ব্যাঙ্ক বা এটিএম না থাকায় চরম ফাঁপরে তাঁরা। সেই খাঁড়ার উপরে এল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) আরও এক নির্দেশ—মঙ্গলবার থেকে আর গ্রাহকদের কাছ থেকে ৫০০ এবং হাজারের নোটে কোনও আমানত বা ঋণ শোধের কিস্তি বাবদ কোনও টাকা নিতে পারবে না সমবায় ব্যাঙ্কগুলি।

কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের এই নির্দেশে সাধারণ গ্রামবাসীর দুর্দশা আরও বাড়াবে বলেই আশঙ্কা করছেন সমবায় ব্যাঙ্কের কর্তারা। বীরভূম জেলায় ধাক্কাটা আরও তীব্র হল, কারণ, দু’বছরেরও বেশি সময় পরে মাত্র দু’মাস আগেই বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লাইসেন্স পেয়েছিল জেলার কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের ১৭টি শাখা। ‘‘এত দিন পরে যখন সবে সাবলীলভাবে চলতে শুরু করছে ব্যাঙ্কগুলি, তখনই এমন নির্দেশ বিশাল সমস্যায় ফেলল’’— বলছেন কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সিইও অজয় গিরি। রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই নির্দেশকে ‘জনবিরোধী’ ও ‘হঠকারী’ বলে তোপ দেগেছে। সেই সুরেই এ দিন তড়িঘড়ি সংবাদমাধ্যমের কাছে বিবৃতি দিয়ে বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘যেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সব শর্ত মেনেই চলছে ব্যাঙ্ক, সেখানে কেন এমন জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেবে তারা? আমরা প্রতিবাদ করছি।’

কেন একে জনবিরোধী বলছেন, তার সমর্থনে যুক্তিও দিয়েছেন নুরুল ইসলাম। তাঁর বক্তব্য, সমবায় ব্যাঙ্কের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন অসংখ্য চাষি। আসন্ন চাষের মরসুমে তাঁরা অত্যন্ত বেকায়দায় পড়ে গেলেন। ঋণ পরিশোধ করে আবার তাঁরা ঋণ নিতেন। কিন্তু, এ দিন শুধু সিউড়ি মূল শাখা থেকেই কয়েকশো চাষি ফিরে গিয়েছেন ঋণ শোধের টাকা জমা না দিতে পেরে। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের কর্মীরা জানাচ্ছেন, লাইসেন্স ফেরত পাওয়ার পরে ব্যাঙ্কের প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন গ্রাহকেরা। কেন্দ্রীয় সরকারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পরে আমানতকারীরা তাঁদের পুরনো নোট (৫০০ ও ১০০০) তো জমা দিচ্ছিলেনই, দীর্ঘদিনের অনাদায়ী ঋণও চাষিদের কাছ থেকে অদায় হচ্ছিল ভাল সংখ্যায়। গত চার দিনে শুধু অচল নোট জমা দেওয়ার সৌজন্যে সাড়ে চার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহ করেছেন এই ব্যাঙ্ক।

মোদ্দা কথায়, ধুঁকতে থাকা জেলা সমবায় ব্যাঙ্কের আর্থিক স্বাস্থ্য পুনুরুদ্ধারে একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল নোট বাতিলের কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত। কিন্তু, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক নির্দেশিকা সেই আশায় জল ঢেলে দিল বলে আশঙ্কা করছেন সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি হয়রানি বাড়বে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য গ্রাহকের। রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী অরূপ রায় সোমবারই প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘গাঁ-গঞ্জে অনেক কৃষকের শুধু সমবায় ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট আছে। তাঁরা যদি সেখানে পাঁচশো-হাজারের নোট বদল করতে বা জমা দিতে না পারেন, তা হলে তাঁরা কোথায় যাবেন?’’

বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ী থাকায় ২০১৪ সালের মে মাসে বীরভূম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের লাইসেন্স রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বাতিল করার পর থেকেই জেলার ১৭টি শাখা বন্ধ ছিল। জেলা জুড়ে সমবায় ব্যাঙ্কের সব ক’টি শাখা বন্ধ হওয়ায় অথৈ জলে পড়েছিলেন ২ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৭৪ জন আমানতকারী। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ৩৫০ কোটি ১২ লক্ষ ৫২ হাজার টাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় ভুগতে শুরু করেন গ্রাহকেরা। চরম সমস্যায় পড়ে যায় সমবায় ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরশীল জেলার ৩৩১টি সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিও। বন্ধ হয়ে যায় চাষিদের কৃষি ঋণ পাওয়া। বছর দেড়েক এ ভাবে সব কিছু বন্ধ থাকার পরে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকার ও নাবার্ডের অর্থ সাহায্য এবং কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে গত বছর অক্টোবরে ব্যাঙ্ক খুলেছিল। কিন্তু একাধিক শর্ত আরোপ করে লাইসেন্স দেয়নি আরবিআই। লাইসেন্স মেলে চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সব শর্তপূরণ করার পরেই।

কিন্তু সুদিনের মুখ সবে দেখা শুরু হতেই ফের ধাক্কা! সমবায় ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের ক্ষোভ, যেখানে বেসরকরি ব্যাঙ্কগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে সমানতালে পরিষেবা দিচ্ছে, সেখানে কেন সববায় ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেই এই বিধিনিষেধ? অনেক বেশি চাষি বা কৃষিজীবীদের স্বার্থ এই ব্যাঙ্কের সঙ্গে জড়িয়ে। এ বার তাঁদের কী হবে?

আরবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, সরকারি নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের পর ব্যাক ডেটে কেরলের একটি সমবায় ব্যাঙ্কে বড় অঙ্কের লেনদেন ধরা পড়ার জেরেই এমন সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কর্মী আধিকারিকদের একাংশও বলছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সমবায়গুলির ক্ষেত্রে অনেক বেশি। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত যে সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতিগুলি রয়েছে, সেখান থেকে এমন অনেক অনৈতিক লেনদেন করা সম্ভব, যা নজরদারিতে আনা কষ্টকর। অন্য ব্যাঙ্কগুলির ক্ষেত্রে ওই ধরনের লেনদেন করা খুবই কঠিন। বিশেষ করে বর্তমান পরিস্থিতিতে। সমবায় ব্যাঙ্কে ৫০০-১০০০ টকার নোটে জমা নেওয়ার উপরে কোপ সেই কারণেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE