Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বৌ আনতে নৌকোয় বর

জল আর জল! বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যেন বিছোনো রয়েছে ঘোলাটে জলের এক চাদর। আর তারই মাঝে নকশার মতো ইতিউতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তালগাছ, খেজুর গাছের মাথা কিংবা বাঁশঝাড়।

লাভপুরের পূর্ব সাহাপুরে কুঁয়ে নদীর এই বাঁধ ভেঙেই প্লাবিত হয়েছে গোটা এলাকা। রবিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

লাভপুরের পূর্ব সাহাপুরে কুঁয়ে নদীর এই বাঁধ ভেঙেই প্লাবিত হয়েছে গোটা এলাকা। রবিবার ছবিটি তুলেছেন সোমনাথ মুস্তাফি।

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৪
Share: Save:

জল আর জল!

বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যেন বিছোনো রয়েছে ঘোলাটে জলের এক চাদর। আর তারই মাঝে নকশার মতো ইতিউতি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে তালগাছ, খেজুর গাছের মাথা কিংবা বাঁশঝাড়।

রবিবার দুপুরে লাভপুরের কুঁয়ে নদীর ধার ঘেঁষা গ্রামগুলিতে দেখা গেল এমনই চিত্র। শনিবার বিকেলে কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় বহু গ্রাম। বাড়ি ঘর ভেঙে নিরাশ্রয় হয়ে পড়েন বহু পরিবার। ব্লক প্রশাসনেরই হিসেব অনুযায়ী, ৩০টি গ্রাম জলমগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজার কাঁচা বাড়ি। এলাকার বাসিন্দাদের অবশ্য দাবি, বাস্তবে ওই সংখ্যা আরও বেশি। তাঁদের হিসেবে প্রায় ৪৫টি জলমগ্ন গ্রামে পাঁচ হাজারেরও বেশি মাটির বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ দিন দুপুরে এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, তখনও জল সরেনি শীতলগ্রামে। কার্যত দ্বীপের মতো হয়ে রয়েছে ওই গ্রাম। গ্রামে ঢোকার রাস্তায় তখন কোমর সমান জল। ওই গ্রাম লাগোয়া বাসস্ট্যান্ডেই দেখা মিলল পেশায় পুরোহিত, স্থানীয় দ্বারোন্দা গ্রামের বাসিন্দা সোমনাথ চক্রবর্তীর। তিনি তখন ভীষণ উদ্বিগ্ন। তাঁকে বিয়ে দিতে যেতে হবে, শীতলগ্রামেই। তাঁর কাছ থেকেই নম্বর নিয়ে ফোনে ধরা হল শীতলগ্রামের সুজিত বাগদিকে। এ দিন তাঁরই কাকা শিবচরণ বাগদির ছেলে রামকৃষ্ণের বিয়ে রয়েছে স্থানীয় বাঘা গ্রামে। সোমনাথবাবুকে যেতে হবে ওই বিয়েরই পুরোহিত হিসেবে। তাঁকে নিতেই কিছু ক্ষণের মধ্যে গ্রাম থেকে নৌকো এলো। সংবাদমাধ্যমেরও সুযোগ মিলল সেই নৌকায় চেপে গ্রামে ঢোকার।

গ্রামে গিয়ে দেখা গেল তখন অলিতেগলিতে জল। শিবদাসবাবুর বাড়ির উঠোন তখনও কাদায় কাদাময়। ছাদনাতলা পাতার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। শিবনাথবাবু বললেন, ‘‘কী করে কী হবে এখনও জানি না। আত্মীয়স্বজনেরাও আসতে পারেননি। রান্নার জোগাড়পাতিও মাথায় উঠেছে। কোনও রকমে নৌকায় ছেলেকে মেয়ের বাড়ি পাঠাতে তো হবে। না হলে মেয়ে যে লগ্নভ্রষ্টা হবে!’’ তিনিই জানালেন, শনিবার বিকেল থেকেই গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে। কোথাও হাঁটু কোথাও বা কোমর সমান জল ছিল। এ দিন সকাল থেকে জল একটু সরলেও, গ্রামের বাসিন্দারা কার্যত জলবন্দি হয়ে রয়েছেন। তাঁর হিসেব অনুযায়ী, গ্রামে ৩০টির বেশি বাড়ি ভেঙে পড়েছে। ত্রাণ বলতে মিলেছে সামান্য চিঁড়ে আর গুড়।

একই পরিস্থিতি রামঘাটির কনক বাগদিরও। এ দিন তাঁর ছেলে সমীরণেরও বিয়ে রয়েছে স্থানীয় শাঁখপুর গ্রামে। কিন্তু, তাঁর বাড়ির দেওয়াল বসে গিয়েছে। বাড়ির উঠোনে প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। ছাদনাতলার সামনে দেওয়া আলপনা কাদায় লেপ্টে একশেষ। টিপটিপ বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে মঙ্গলঘট চাপা দেওয়া হয়েছে ঝুড়ি দিয়ে। কনকবাবু বলেন, ‘‘আজ আমার বাড়িতে বহু লোকের পাত পেড়ে খাওয়ার কথা। কিন্তু, গত কাল থেকে আমরাই মুড়ি চিবিয়ে রয়েছি। সব অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে হয়েছে। জল ঢুকে উনুন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাঁধা প্যান্ডেলের কাপড় ত্রিপলও উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে ঝড়।’’ এমন পরিস্থিতিতে ছেলেকে কী করে বিয়ে দিতে পাঠাবেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না কনকবাবু।

ওই বিয়ের প্যান্ডেলের পাশেই গ্রামের প্রাথমিক স্কুল। সেখানে তখন তিনটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদেরই অন্যতম রিলিফা বিবি বলেন, ‘‘শনিবার থেকে আমাদের হাঁড়ি চড়েনি। বাড়ির নীচে চাপা পড়েছে রান্না করার সরঞ্জাম এবং খাদ্য সামগ্রী। এখনও তা বের করতে পারেনি। প্রশাসন পরিবার পিছু দু’সের চিঁড়ে আর সামান্য গুড় দিয়ে গিয়েছে। সেই খেয়েই রয়েছি।’’ ওই গ্রামেরই শেখ পাড়ায় তখন কপাল চাপড়াচ্ছিলেন রুবাই বিবি। জল ঢুকে তাঁর বাড়ি ভেঙে পড়েছে। তারই নীচে চাপা পড়ে রয়েছে গৃহস্থালীর সরঞ্জাম-সহ অন্যান্য সামগ্রীও। এখনও পর্যন্ত কিছুই বার করতে পারেনিনি তিনি। কারণ, তাঁর স্বামী জাহির শেখ কর্মসূত্রে বাইরে রয়েছেন। তিন ছেলেমেয়েক নিয়ে রুবাই তাই পড়েছেন চরম সমস্যায়। তিনি বললেন, ‘‘সব কিছু বাড়ির তলায় চাপা পড়ে রয়েছে। কিছুই বের করতে পারিনি। আমি একা মেয়ে মানুষ। কিছুই বের করতে পারিনি। কাল থেকে ছেলেমেয়ের মুখেও কিছু তুলে দিতে পারিনি। আজ সকালে কিছু চিঁড়ে-গুড় পেয়েছিলাম। ওদের খাইয়েছি। কিন্তু ওরা কিছুতেই খেতে চাইছিল না। ভাত খাওয়ার বায়না ধরেছিল। জানি না কবে ওদের মুখে ভাত তুলে দিতে পারব।’’

এই বন্যা কবলিত পরিস্থিতিতে নিজেদের তো বটেই গবাদি পশুদের নিয়েও দুর্গত মানুষেরা পড়েছেন মহা সমস্যায়। এমনিতেই গ্রামের দুস্থ মানুষ জন গাছের পাতা এবং মাঠের ঘাসের উপর নির্ভর করে গবাদি পশু পালন করেন। কিন্তু, এলাকা জলমগ্ন হয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ হারিয়েছেন তাঁরা। পূর্ব সাহাপুর গ্রামের মধুসূদন মণ্ডল, বিশ্বনাথ বাগদি, কানন মণ্ডলেরা বলেন, ‘‘মানুষের জন্য দেরিতে হলেও তবু রিলিফ আসে। গবাদি পশুর জন্য তো কোনও রিলিফ বরাদ্দ নেই। তাই ভেঙে পড়া বাড়ির চালের খড়ই ওদের খাওয়াতে হচ্ছে।’’ ওই গ্রাম থেকেই দেখা গেল, শীতল গ্রামের মতো পুরোপুরি জলবন্দি হয়েছে বকুলবাটী গ্রামও। স্থানীয় সুখেন মণ্ডল, আশিস বাগদিরা বললেন, ‘‘গোকুলবাটি এবং সাহাপুরের কাছে দুই জায়গায় বাঁধ ভেঙে ৪৫টি গ্রাম জলমগ্ন হয়েছে। পাঁচ হাজারেরও বেশি বাড়ি ভেঙে পড়েছে। আজও তিন-চারটি গ্রাম পুরোপুরি জলবন্দি রয়েছে।’’ তবে, এ দিন জল সরতে শুরু করলেও এলাকায় আরও বাড়ি ধসে পড়ার আশঙ্কা করছেন বাসিন্দারা।

এ দিকে, যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্ট লাভপুরের বিডিও জীবনকান্তি বিশ্বাস জানান, কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তিন হাজারের বেশি মাটির বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত। দুর্গত এলাকাগুলিতে তাৎক্ষণিক ভাবে চিঁড়ে-গুড় পাঠানো হয়েছে। আপদকালীন ব্যবস্থা হিসেবে গ্রামের আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিতে যে সব খাদ্য সামগ্রী জমা রয়েছে, তা রান্না করে দেওয়ার জন্য এলাকার জন প্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাঁর দাবি, পর্যাপ্ত ত্রানের ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। গবাদি পশুর খাদ্যাভাবের বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE