Advertisement
E-Paper

বিদ্যুৎহীন ঘর থেকে আলোর দিশা

স্বামী দিনমজুর ছিলেন। দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হওয়ার পরে দুই মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন মুন্নাদেবী। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। কিন্তু অন্ধকার ঘরে বসেই আশার আলোর কথা লিখেছিল তাঁর বড় মেয়ে সমাপ্তি গড়াই। ইংরেজিতে লেখা সেই কবিতা রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় এবং জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৬ ০০:৫৩

স্বামী দিনমজুর ছিলেন। দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হওয়ার পরে দুই মেয়েকে নিয়ে অথৈ জলে পড়েন মুন্নাদেবী। বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। কিন্তু অন্ধকার ঘরে বসেই আশার আলোর কথা লিখেছিল তাঁর বড় মেয়ে সমাপ্তি গড়াই। ইংরেজিতে লেখা সেই কবিতা রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় এবং জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। বাঁকুড়ার মেজিয়ার তারাপুর সুকান্ত স্মৃতি বিদ্যাপীঠের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সমাপ্তি।

মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর পাঁচদিন আগেই বাবাকে হারিয়েছিল সে। কিন্তু থেমে থাকেনি। তার পরেও পরীক্ষা দিয়েছে। মার্কশিটে জমা হয়েছে ৯০ শতাংশেরও বেশি নম্বর। বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্রী সমাপ্তি যখন তার ইংরাজি কবিতার জন্য পুরস্কার নিতে গিয়েছে, তার মা মুন্না গরাই বাড়িতে বসে আবেগে কেঁদে ফেলেন। বলেন, “আমি লেখাপড়া জানি না। স্বামীও জানতেন না। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেছিলাম দু’জনে।’’

এ রকমই টুকরো টুকরো অনেক ছবি উঠে এল বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার কন্যাশ্রী দিবসের দিন। কারও বাবা দিনমজুর, কেউ বা ছোট চাষি। কারও গ্রাম বাস যায় না। তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে বড় রাস্তায় এসে বাস ধরে স্কুলে পৌঁছতে হয়। কেউ পুরো পথটাই পাড়ি দেয় সাইকেলে। কিন্তু কোনও বাধাই ওদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। কন্যাশ্রী দিবসের মঞ্চে ফের এক বার সে কথা প্রমাণ হয়ে গেল। এলাকার মেয়েদের সাফল্যে বেজায় খুশি তাদের এলাকার বাসিন্দারাও। মেজিয়া ব্লকের তৃণমূল সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সমাপ্তিরা বাকিদের পথ দেখাবে।’’

সম্প্রতি বিভিন্ন জেলা প্রশাসন কন্যাশ্রী বিষয়ক কবিতা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার স্কুলগুলির ছাত্রীরা বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি ও সাঁওতালি ভাষায় কবিতা লিখে জমা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে সফল ছাত্রীরা এ দিন উঠে এল কন্যাশ্রী দিবসের মঞ্চে। পুরুলিয়ার রবীন্দ্র ভবন এবং বাঁকুড়া জেলা পরিষদের অডিটোরিয়ামে এ দিন তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। পুরুলিয়া জেলা সমাজ কল্যাণ আধিকারিক নীলিমা দাস চৌধুরীর কথায়, ‘‘শুধু প্রথম-দ্বিতীয় হওয়া মেয়েরাই নয়, ছোট ছোট অনেক মেয়ে খুব সুন্দর কবিতা লিখেছে। বিভিন্ন স্কুল থেকে অনেক কবিতা পেয়েছি আমরা। তার মধ্যে প্রথম-দ্বিতীয় বাছতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছেন বিচারকরা।’’

বাংলায় কবিতা লিখে পুরুলিয়ায় প্রথম হয়েছে বান্দোয়ান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী তনিমা মুখোপাধ্যায়। মধুপুর গ্রামের দুঃস্থ পরিবারের মেয়ে তনিমার বাড়িতে একটিই সাইকেল। সেটি নিয়ে যদি বাবা কাজে বেরিয়ে যান, তাহলে কিছুটা পথ হেঁটে, কিছুটা বাসে চড়ে স্কুলে যেতে হয়। সেই মেয়েই লিখেছে চারটি পঙ্‌ক্তি— ‘কন্যাশ্রী এসে দিল ভরসা/ নতুন আশা জাগে/ বিয়ের পিঁড়ি দূরে থাক/ শিক্ষা-স্বাস্থ্য আগে’। এ রকম মনের কথা সহজ সরল করে লিখেই সবার নজর কেড়়েছে কৃষ্ণপুর জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়ের নমিতা মাহাতো ও শিরকাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের পায়েল মাঝি। ওই বিভাগে তারা যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছে। সাঁওতালিতে বাগতবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের রেবতী হেমব্রম প্রথম, কৃষ্ণপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের অভাগিয়া হেমব্রম দ্বিতীয় এবং বান্দোয়ান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের জয়ন্তী মুর্মু তৃতীয় হয়েছে। বান্দোয়ানের পদগোড়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক পরিবারের মেয়ে জয়ন্তীর বলে, ‘‘আমি আমার মতো মেয়েদের অধিকারের কথাই লিখেছিলাম।’’

ইংরেজিতে কবিতা লিখে পুরুলিয়ায় প্রথম হয়েছে বাঘমুণ্ডি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়। চেলিয়ামা বিসি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের তনু কাটারুকা দ্বিতীয় ও পুরুলিয়া রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের ইতি মাঝি তৃতীয় হয়েছে। বাঘমুণ্ডির মাদলা গ্রামের মেয়ে সঞ্চিতার কথায়, ‘‘আমাদের ব্লকেরই মেয়ে বীণা কালিন্দী। নিজের বিয়ে রুখতে ওর রুখে দাঁড়ানোই আমার প্রেরণা।’’

পুরুলিয়া ২ ব্লকের হরিয়ালগাড়া গ্রামের ইতি মাঝি জানায়, কন্যাশ্রী তাকে অভাবের সঙ্গে লড়তে শিখিয়েছে। সেই কথাই লিখেছে সে। পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক রাধারানি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েরা ইংরাজিতে কবিতা লিখছে। তা ছাড়াও গ্রামের অনেক মেয়েই নানা ভাষায় তাদের অধিকারের কথা, প্রতিবাদের কথা, স্বপ্নের কথা সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছে। এটাই এই প্রতিযোগিতার পাওনা।’’ পুরুলিয়ায় উর্দু ভাষায় প্রতিযোগী কম থাকায় দু’জনকে বেছেছেন জেলার বিচারকেরা। তার মধ্যে প্রথম হয়েছে গুলনার পরভীন।

পাড়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের জুবেদা খাতুন হয়েছে দ্বিতীয়। হিন্দি কবিতায় হুটমুড়া হরিমতী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের পল্লবী গড়াই প্রথম, সাঁওতালডিহি কোল ওয়াসারি উচ্চ বিদ্যালয়ের রিয়া শর্মা দ্বিতীয় ও আদ্রা মিশন জুনিয়র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সুজাতা কুমারী তৃতীয় হয়েছে।

বাঁকুড়া ২ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম মগরার ছাত্রী চম্পা কর্মকার লিখেছে, দারিদ্রের জন্য কী ভারে তার সহপাঠীদের পড়া ছাড়িয়ে বসানো হয় বিয়ের পিঁড়িতে। চম্পা লিখেছে, ‘মেয়ে বলে ফেলনা না কি, আর কেঁদোনা মা।/ কম বয়সে বিয়ে দেবে, ভুলেও ভেবো না।/ লিখব, পড়ব, জীবন গড়ব, অনেকটা পথ বাকি।/ কন্যাশ্রী সঙ্গে আছে ভয়টা আমার কী!’ চম্পার এই কবিতা বাংলায় জেলার মধ্যে প্রথম হয়েছে। ছাত্রীর সাফল্যে গর্বিত তার স্কুল মগরা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষিকারাও। তার মধ্যে রয়েছেন চম্পার বাবা গৌতম কর্মকারও। তিনি নিজে ওই স্কুলেরই পার্শ্ব শিক্ষক। সাঁতালি ভাষায় কন্যাশ্রী ছড়া লিখে বাঁকুড়ায় প্রথম হয়েছে বাসুদেবপুর জুনিয়র হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মহুয়া মুর্মু।

হিন্দিতে কন্যাশ্রী নিয়ে কবিতা লিখে বাঁকুড়ায় প্রথম হয়েছেন বড়জোড়ার উড়ানপাড়ার বাসিন্দা কৌশল্যা সাউ। কৌশল্যার বাবা প্রদীপ সাউ ছেঁড়া চট কেনা বেচার ব্যবসা করেন। তার মধ্যেই তিন মেয়ে এবং এক ছেলের পড়াশোনার খরচ টেনে চলেছেন তিনি। কৌশল্যার কথায়, “আমাদের জন্য অনেক অভাবের সঙ্গে লড়াই করেছেন বাবা। কন্যাশ্রী এমন অনেক বাবার কাঁধে হাত রেখে ভরসা দিয়েছে।’’ সেই কথারই রেশ ধরা পড়ল পুরুলিয়ার সাংসদ মৃগাঙ্ক মাহাতোর কথাতেও। তিনি বলেন, ‘‘কন্যাশ্রী এখন আর শুধু একটা প্রকল্প নয়। ছাত্রীদের এই লেখাগুলিই প্রমাণ করছে কন্যাশ্রী এখন তাঁদের স্বপ্নের যাদুকাঠি।’’

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy