আগেও তাঁকে দু’বার গুলি করে খুনের চেষ্টা হয়েছিল। শেষ বার খুনের চেষ্টার খবর ছড়াতেই নৃশংস ভাবে পাল্টা খুন করা হয়েছিল এলাকার প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ককে। শেষমেশ বাড়ির সামনেই মোটরবাইকে আসা চার দুষ্কৃতীর এলোপাথাড়ি গুলিতে নিহত হলেন তৃণমূলের সেই নেতা।
শুক্রবার সকাল ৮টা নাগাদ নানুরের সাওতায় ১ নম্বর বাসস্টপ লাগোয়া এলাকার ঘটনা। পুলিশ জানায়, নিহতের নাম শামসুল হোদা ওরফে ফুলু (৪৮)। সাওতা গ্রামেই তাঁর বাড়ি। তিনি তৃণমূলের নানুর ব্লক কমিটির সদস্য ছিলেন। তাঁর স্ত্রী জেসমিন বিবি নানুর পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য। দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নাকি দুষ্কৃতীদের এলাকা দখলের লড়াই এই খুনের নেপথ্যে— তা নিয়ে ধন্দে রয়েছে পুলিশ। স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্বকে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, এলাকা দখল করার জন্য সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই ওই নেতাকে খুন করেছে। সিপিএম নেতৃত্ব যদিও ওই অভিযোগ মানেননি।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এর আগে শামসুলকে একাধিক বার খুনের চেষ্টা হয়েছে। তিনি একসময় ছিলেন আরএসপি-র নানুর উত্তর লোকাল সম্পাদক তথা জেলা কমিটির সদস্য। সেই সময় গ্রাম তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে ঘিরে ওই এলাকায় সিপিএমের সঙ্গে আরএসপি-র সংঘর্ষ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। ২০০৭ সালে ওই বাসস্ট্যান্ডেই শামসুলকে বাস থেকে নামিয়ে গুলি করে খুনের চেষ্টার অভিযোগ ওঠে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিতে জখম হন তাঁর বোন ইব্রাতুন খাতুন এবং কাকা গোলাম আম্বিয়াও। ২০১০ সালের মার্চ মাসে হাজারখানেক কর্মী-সমর্থক নিয়ে দলের জোনাল সম্পাদক শেখ সাদেককে নিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন শামসুল। ওই বছরই জুন মাসে নানুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে ফের গুলিবিদ্ধ হন তিনি। অভিযোগ ওঠে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। তার বদলা নিতে ওই দিন সন্ধ্যাতেই নিজের বাড়ির সামনে নৃশংস ভাবে খুন করা হয় সিপিএমের প্রাক্তন বিধায়ক আনন্দ দাসকে।
এ দিন সকাল ১০টা নাগাদ গিয়ে দেখা গেল নানুর-বোলপুর সড়ক লাগোয়া শামসুলের বাড়িতে তালা ঝুলছে। পড়শিরা জানান, সবাই বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে গিয়েছেন। এলাকায় র্যাফ ও বিরাট পুলিশ বাহিনী টহল দিচ্ছে। দোকানপাট সব বন্ধ। শামসুলের বাড়ির দরজার সামনে তখনও পড়ে রয়েছে তাজা রক্ত। উল্টো দিকে কুমিড়া যাওয়ার ঢালাই রাস্তায় তখনও পড়ে রয়েছে দু’টি গুলির খোল। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ওই গ্রামেরই বাসিন্দা তথা নিহত নেতার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী (তৃণমূলের ব্লক কমিটির সদস্য) সেখ সাদেক জানান, রোজকার মতো এ দিনও তাঁরা দু’জন শামসুলের বাড়ির সামনেই বাসস্টপের একটি দোকানে চা খেতে গিয়েছিলেন। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে এ দিনই থানার ওসি-র সঙ্গে বৈঠক ছিল। তা নিয়েই তাঁরা আলোচনা করছিলেন।
সাদেকের দাবি, ‘‘আচমকাই দু’টি মোটরবাইকে চেপে চার জন লোক আমাদের পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। তার পর আমাদের কাছে এসে হঠাৎ দু’জন পকেট থেকে বন্দুক বের করে শামসুলকে লক্ষ করে গুলি চালায়।’’ তিনি জানান, প্রথমে শামসুলের পেটে গুলি লাগে। ওই অবস্থায় তিনি পালানোর চেষ্টা করলে দুষ্কৃতীরা তাঁকে ঘিরে ধরে মোট সাতটি গুলি চালায়। তিনটি গুলি শামসুলের গায়ে লাগে। তার পরেই লুটিয়ে পড়েন শামসুল। সাদেকের কথায়, ‘‘ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। তত ক্ষণে দুষ্কৃতীরা নানুরের দিকে চম্পট দেয়। শামসুলকে তুলে ঘরে নিয়ে যাই।’’ সেখান থেকে প্রথমে নানুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং পরে বর্ধমানে নিয়ে যাওয়ার পথেই মৃত্যু হয় ওই তৃণমূল নেতার।
স্বাভাবিক ভাবেই খুনের কারণ নিয়ে ধন্দে পড়েছে পুলিশ। আরএসপি-তে থাকাকালীন সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতী দুই ভাইয়ের সঙ্গে লড়াই হতো শামসুলদের। তাদের মধ্যে এক ভাই লাভপুরে এক তৃণমূল কর্মী খুনের দায়ে বর্তমানে যাবজ্জীবন জেল খাটছেন। অন্য ভাই-সহ তৎকালীন বেশ কিছু সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতী দীর্ঘ দিন ধরে শামসুলদের দাপটে গ্রামছাড়া রয়েছেন। তারাও ফের গ্রাম দখলের জন্য খুন করতে পারে বলে জেলা পুলিশের একাংশের অভিমত। আবার পুলিশেরই অন্য একটি অংশ শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের তত্ত্বকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
তৃণমূল সূত্রের খবর, শামসুল একসময় নানুরের দাপুটে প্রাক্তন তৃণমূল যুব নেতা কাজল শেখের অনুগামী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। বিধানসভা ভোটের আগে তিনি দলের বর্তমান যুব সভাপতি গদাধর হাজরার গোষ্ঠীতে নাম লেখান। অন্য দিকে, সিপিএম আশ্রিত ওই দুষ্কৃতীরা কাজলের গোষ্ঠীতে নাম লেখান। বিধানসভা ভোটের পরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন কাজলের অনুগামীরা। হৃত ক্ষমতা ফিরে পেতে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের সঙ্গে মিলে কাজলের অনুগামীদেরও শামসুলকে সরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে হাতে থাকতে পারে বলে পুলিশের একাংশের অনুমান।
এ বিষয়ে এ দিন কাজলের কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে, তাঁর এক অনুগামীর দাবি, ‘‘ওই খুনের বিষয়ে দাদার কোনও ভূমিকা নেই।’’ অন্য দিকে, নানুরের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তথা দলের জেলা যুব সভাপতি গদাধর হাজরার দাবি, ‘‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কোনও ব্যাপার নয়। এলাকা দখলের জন্য সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই শামসুলকে খুন করেছে।’’ সেই অভিযোগ অস্বীকার করে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আনন্দ ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘ওই খুনের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ওদের নিজেদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণেই ওই খুন বলে আমাদের অনুমান।’’
অন্য দিকে, এ দিন বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে স্বামীর মৃতদেহ আঁকড়ে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিলেন আমেতুন্না বিবি। তাঁর অভিযোগ, ‘‘রাতেই থানার বড়বাবুকে ফোন করে বলেছিলাম, দুষ্কৃতীরা গ্রামের দখল নেওয়ার জন্য জড়ো হচ্ছে। বড়বাবু দুষ্কৃতীদের হঠিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কিছুই করেননি। তাই আমার স্বামীকে প্রাণ দিতে হল!’’
যদিও এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করেননি জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার। তবে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনায় নিহতের পরিবার এখনও পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ দায়ের করেনি। আপাতত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।