Advertisement
E-Paper

শান্ত পুরুলিয়া ভোটের মুখে হঠাৎ অশান্ত

এ রাজ্যের যে-সব জেলা নির্বাচনী হিংসার তালিকায় উপরের দিকে থাকবে, এই জেলা তার মধ্যে কখনওই পড়ে না। ভোটের সময় রাজনৈতিক হিংসা দেখতে অভ্যস্ত নন এই জেলার মানুষ। এ বছর পুরভোটের মুখে কিন্তু বিক্ষিপ্ত অশান্তি ছড়াচ্ছে সেই পুরুলিয়ােতই। দিন কয়েক আগেই পুরুলিয়া শহরের এক বিজেপি কর্মীর বাড়িতে হামলার অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। দোলমালের মাঝে পড়ে হাত ভাঙে এক কিশোরেরও।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০২
শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মহিলারা ত্রাণের ত্রিপল চেয়ে লাইন দিয়েছেন পুরুলিয়া পুরসভায়। এই ত্রাণ বিলি নিয়ে অভিযোগ ঘিরেই সংঘর্ষ।

শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মহিলারা ত্রাণের ত্রিপল চেয়ে লাইন দিয়েছেন পুরুলিয়া পুরসভায়। এই ত্রাণ বিলি নিয়ে অভিযোগ ঘিরেই সংঘর্ষ।

এ রাজ্যের যে-সব জেলা নির্বাচনী হিংসার তালিকায় উপরের দিকে থাকবে, এই জেলা তার মধ্যে কখনওই পড়ে না। ভোটের সময় রাজনৈতিক হিংসা দেখতে অভ্যস্ত নন এই জেলার মানুষ। এ বছর পুরভোটের মুখে কিন্তু বিক্ষিপ্ত অশান্তি ছড়াচ্ছে সেই পুরুলিয়ােতই।

দিন কয়েক আগেই পুরুলিয়া শহরের এক বিজেপি কর্মীর বাড়িতে হামলার অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। দোলমালের মাঝে পড়ে হাত ভাঙে এক কিশোরেরও। এ বার ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য ত্রাণের ত্রিপল বিলিকে ঘিরে কংগ্রেস-তৃণমূল সংঘর্ষ হল পুরুলিয়া শহরে। বুধবার দুপুরে শহরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ওই ঘটনা।কংগ্রেসের অভিযোগ, তাদের মিছিলে এ দিন হামলা চালায় তৃণমূল। পাশাপাশি ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী বিভাস দাসের বাড়িতেও হামলা হয়। অভিযোগ অস্বীকার করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালানোর দাবি করেছে শাসকদল।

ওই সংঘর্ষে ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী বিভাস দাস এবং তৃণমূল প্রার্থী কমল মিশ্র-সহ দু’পক্ষের ৫ জন আহত হয়েছেন। তাঁরা সদর হাসপাতালে ভর্তি। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় পুলিশ ও র‌্যাফের টহল শুরু হয়েছে। আক্রান্ত কংগ্রেস প্রার্থীর বাড়ির সামনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, দু’দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।

গত রবিবার শহরে মিনিট পনেরোর ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে বহু এলাকার শতাধিক পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকার মহিলারা লাইন দিয়ে জেলাশাসকের অফিস এবং পুরসভায় গিয়ে ত্রিপল-সহ ত্রাণের দাবি করছেন। পুরভোটের মুখে এই ক্ষতি নিয়ে যথারীতি শুরু হয়েছে রাজনীতি। আর তা নিয়েই এ দিন অশান্তির সূত্রপাত। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী কমল মিশ্রের অভিযোগ, রবিবারের শিলাবৃষ্টিতে যাঁদের চালা নষ্ট হয়েছে, তাঁরা ত্রিপল চাইছেন। এই ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর হিসেবে বিভাসবাবু যাঁরা ত্রিপল পাবেন, তাঁদের নামের তালিকা তৈরি করছেন। কিন্তু, সেখানে উনি তৃণমূলের সমর্থকদের নাম লিখছেন না। কমলবাবুর বক্তব্য, ‘‘এটা নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আসায় আমরা তাঁকে বলি সকলের নাম লিখতে। উনি সে কথা কানে তোলেননি। এ দিন এ সব কথা বলার মাঝেই আমাদের উপরে কংগ্রেসের লোকজন হামলা করে।’’

ত্রাণের তালিকা তৈরি নিয়ে কমলবাবুর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিভাসবাবু। তাঁর বক্তব্য, এ দিন ঠিক কী ঘটেছে, তার সাক্ষী এলাকারই মানুষ। বিদায়ী কংগ্রেস কাউন্সিলরের পাল্টা দাবি, এ দিন দুপুরে তাঁরা এলাকায় মিছিল করছিলেন। মিছিল তাঁর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তৃণমূলের লোকজন তাঁদের উপরে হামলা চালায়। বিভাসবাবুকে কোনও কিছু দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। তিনি কোনও রকমে মাথা সরিয়ে নিলেও তাঁর কানে আঘাত লাগে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল আচমকা হামলা চালানোয় আমাদের কর্মীরা যে যেদিকে পারেন ছুটতে শুরু করেন। খুব কাছেই আমার বাড়ি। তাই ওদের হাত থেকে বাঁচতে আমি ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে যাই। তৃণমূলের ছেলেরা তখন আমার বাড়িতেও চড়াও হয়।’’

হামলায় এই ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী কমল মিশ্রও ছিলেন বলে বিভাসবাবুর দাবি। বিভাসবাবুর স্ত্রী মৈত্রেয়ী দাস বলেন, ‘‘আমার স্বামী যখন বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন, তখন হামলাকারীরা বাড়ি লক্ষ করে ঢিল মারতে থাকে। আমাদের বাড়ির বারান্দার কাচ ভেঙে যায়।’’ বিভাসবাবুর ভাই বিশ্বজিৎ দাস শহরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে কংগ্রেসের টিকিটেই প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমাদের কর্মীরা তো মার খেয়েইছে। গোলমাল শুনে পাড়ার যে মহিলারা বেরিয়েছিলেন, তাঁরাও তৃণমূলের হামলাকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে আহত হয়েছেন।’’ তেমনই এক মহিলা জানান, পাড়ায় পানের দোকানের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তখন দেখেন, বিভাসবাবু ও তাঁর সঙ্গীরা ছুটতে ছুটতে আসছেন। আর পিছন থেকে ঢিল ছুড়ছে কিছু লোক। ওই মহিলার কথায়, ‘‘কত বছর এই এলাকায় থাকছি। ভোট নিয়ে কখনও এমন ঘটনা দেখিনি।’’

আর এক মহিলার কথায়, ‘‘গোলমাল শুনে ছেলেকে দেখতে বাইরে বেরোতেই পায়ে একটা বড় ঢিল পড়ল। পিছন থেকে যারা তাড়া করে আসছিল, সেদিক থেকেই ঢিলটা উড়ে এল। এর পরেই এক জন এসে বলল, ‘ঘরে ঢুকে যা, না হলে মেরে দেব!’ এ সব কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এ রকম কখনও দেখিনি এই এলাকায়।’’ ঘটনার পরে এলাকায় যান জেলা পুলিশের ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) কুন্তল বন্দ্যোপাধ্যায়, সিআই (পুরুলিয়া) আশিস বটব্যাল, পুরুলিয়া সদর থানার ওসি সাধন পাঠক। পুলিশ বাহিনী এলাকায় টহল দিতে শুরু করে।

তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তৃণমূল প্রার্থী কমল মিশ্রের দাবি, ‘‘আমরা ওদের মিছিলে মোটেই আক্রমন করিনি। উল্টে আমাদেরই ওরা আক্রমণ করেছে। বিভাস ও তাঁর ভাই বিশ্বজিৎ-সহ আরও কয়েক জন হামলা চালিয়েছে। আমার বাঁ হাতে আঘাত লেগেছে। আমার দাদা মাথায় চোট পেয়েছে।’’ আপনাদের কর্মীরা বিভাসবাবুর বাড়ি আক্রমণ করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে? কমলবাবুর দাবি, দিন কয়েক আগের শিলাবৃষ্টিতে বারান্দার কাচ ভেঙেছে। এখন তা তৃণমূলের হামলা বলে চালানো হচ্ছে। এ কথার জবাবে বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘আমাদের উঠোন জুড়ে প্রচুর ইটের টুকরো পড়ে রয়েছে। সকলেই দেখেছেন। মিছিলে থাকা আমাদের এক কর্মী এখনও নিখোঁজ।’’

কংগ্রেস প্রার্থীর বাড়ির জানলার ভাঙা কাচ। অভিযোগ, তৃণমূলের লোকজনের ছোড়া ইটেই ওই কাচ ভাঙে। বুধবারের নিজস্ব চিত্র।

বিভাসবাবুকে দেখতে এ দিন হাসপাতালে আসেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘শান্ত পুরুলিয়ায় কলকাতার সংস্কৃতি ঢোকানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল। আমি তৃণমূলের পুরপ্রধান পদপ্রার্থী কে পি সিংহদেওয়ের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, তাঁরা কি এ ভাবেই ভোটে জিতে যে কোনও মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান?’’ নেপালবাবুর হুঁশিয়ারি, পুলিশ কী ভূমিকা নেয়, তা তাঁরা দেখবেন। পুলিশ নিরপেক্ষ না হলে আন্দোলন হবে। পুরুলিয়ার বিধায়ক কে পি সিংহদেও অবশ্য বলেছেন, ‘‘এটি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা নয়। ত্রাণের ত্রিপল বিলি করাকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষ। ত্রাণ নিয়ে দলবাজি করতে গিয়ে ওই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী নিজে জনরোষের শিকার হয়েছেন। এখন উল্টে তৃণমূলের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন।’’ তা হলে তৃণমূলের কর্মীরা কী ভাবে আহত হলেন, জানতে চাওয়ায় তাঁর দাবি, কাছাকাছি ওই কর্মীরা ছিলেন। তাঁরা মানুষের হয়ে কথা বলতে যাওয়ায় বিভাসবাবুর ভাই দলবল নিয়ে তৃণমূলের কর্মীদের উপরে চড়াও হন।

বিধায়কের আরও মন্তব্য, ‘‘আমরা এই ঘটনার নিন্দা করছি। আমি এখনও বলতে চাই, পুরুলিয়ায় এই সংস্কৃতি নেই। এখানে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবেই নিবার্চন হয়।’’ একই সুরে নেপালবাবু বলছেন, ‘‘রাজনৈতিক সংঘর্ষ এখানে বিরল ঘটনা। এই ধরনের ঘটনার ফলে এই জেলায় যে শান্তিপূর্ণ বাতাবরণে নিবার্চন হয়, তা নষ্ট হবে।’’

শান্তির সংস্কৃতি কোথাও কি বিপন্ন—প্রশ্ন কিন্তু উঠেই গিয়েছেন জেলার মানুষের মনে।

Political clash Purulia Trinamool municipal election congress election
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy