E-Paper

বিশেষ ছত্রাকে ক্যানসাররোধী ক্ষমতা, শৈশবের স্মৃতি থেকে গবেষণা অধ্যাপকের

কলেজে ক্যানসাররোধী ‘ড্রাগ’ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে আধুনিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি তৈরি করেন ওই অধ্যাপক।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০২৫ ১০:০০
কুড়কুড়ে ছাতু। স্বপন কুমার ঘোষ।

কুড়কুড়ে ছাতু। স্বপন কুমার ঘোষ। ক্যানসাররোধী।

বর্ষাকালে শাল-মহুয়ার জঙ্গলে জন্মানো এক ধরনের মাশরুম বা ছত্রাক ‘কুড়কুড়ে ছাতু’-এর মধ্যেই লুকিয়ে মারণ রোগ ক্যানসাররোধী ক্ষমতা। সম্প্রতি বিশ্বমঞ্চে গবেষণালব্ধ এই ফল প্রকাশ্যে এনেছেন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ সেন্টিনারি কলেজ (অটোনমাস)-এর অধ্যাপক, গবেষক স্বপনকুমার ঘোষ।

আদতে খয়রাশোলের বাসিন্দা স্বপনকুমারের গবেষণাপত্রটি গত মাসে প্রকাশিত হয়েছে প্রখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকার সায়েন্টিফিক রিপোর্টস বিভাগে। প্রাকৃতিক মাশরুম থেকে প্রাপ্ত উপাদন জরায়ুমুখ, স্তন ও ফুসফুসের ক্যানসার নিরাময়ে ও প্রতিরোধে যুগান্তকারী ভূমিকা নেবে এ বিষয়ে নিশ্চিত ওই গবেষক।

ওই কলেজে ক্যানসাররোধী ‘ড্রাগ’ তৈরির উদ্দেশ্য নিয়ে আধুনিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি তৈরি করেন ওই অধ্যপক। রাজ্য ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অর্থ সাহায্যে গড়ে ওঠা ওই ল্যাবে মূলত আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা গাছ, মাইক্রোবস এবং মাশরুম থেকে ক্যানসাররোধী উপাদান পাওয়া যায় কিনা সেটিই গবেষণার বিষয়। সেখানেই বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় বর্ষাকালে শাল, মহুয়া, হরিতকীর জঙ্গলে প্রাপ্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর কুড়কুড়ে ছাতু বা ছত্রাকের উপরে গবেষণা চালান তিনি। এর বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাসট্রায়েস এশিয়াটিকাস (Astraeus asiaticus)। ওড়িশায় এই ছত্রাকের নাম রুগদা। চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য মেলে। তাঁকে সাহায্য করেছেন আরও তিন গবেষক ছাত্র কৌশিক পাণ্ডে, মধুপর্ণা ঘোষ এবং পিকে সুর। ওই অধ্যাপক বলেন, “গবেষণা করে কুড়কুড়ে মাশরুম থেকে ৬১টি কম্পাউন্ড (বায়োঅ্যাকটিভ) মিলেছিল। পরিশোধন করে ‘এফ-১২ প্রোডাক্ট’ পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে ৬টি কম্পাউন্ড পেলাম, যা শুধু অ্যান্টি ক্যানসার বা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট নয়, ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স হওয়াও প্রতিরোধ করতে পারে।”

কী ভাবে সেটিও ব্যাখ্যা করেছেন অধ্যাপক-গবেষক। শ্বাসের সঙ্গে বায়ু থেকে নেওয়া অক্সিজেন শরীরে রাসায়নিক ক্রিয়া ঘটিয়েই চলেছে। নানা জৈবিক ক্রিয়ার ফলে প্রচণ্ড বিক্রিয়া করার প্রবণতা সম্পন্ন প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি তৈরি হয়। যেগুলি ‘রস’ আরওএস বা (রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিস) বলে। ‘রস’ যদি শরীরে জমতে থাকলে কোষের ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডিএনএ-র কেমিক্যাল বন্ড। ক্যানসার হয় তখনই। ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটানোর প্রক্রিয়াকে বলে ‘অ্যাপোপটোসিস’। ক্যানসার হলে ‘অ্যাপোপটোসিস’ বন্ধ হয়ে যায়।

স্বপনকুমার ঘোষের দাবি, এফ ১২ ক্যানসার কোষের ‘অ্যাপোপটোসিস’ ঘটাতে সাহায্য করে। তিনি যোগ করেছেন, শরীরের মধ্যেই অ্যান্টি ক্যানসার মেকানিজ়ম ক্যানসারের জিন আছেই। যেমন, ক্যাসপেস ৩ এবং ৯ তার মধ্যে ক্যানসার কোষের ‘অ্যাপোপটোসিস’ ঘটাতে সক্ষম। অন্য দিকে বিসিএল ২ ‘অ্যাপোপটোসিস’-এর বিরোধী। পি-৫৩ নামে একটি জিন রয়েছে যাকে গার্জেন অফ জেনম বলা হয় তার টিউমার প্রতিরোধী ক্ষমতা রয়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এফ-১২ প্রোডাক্ট পি-৫৩-কে প্রভাবিত করে। ক্যাসপেস ৩ এবং ৯-কে সজাগ করে। অন্য দিকে, বিসিএল ২-কে বাধা দেয়। ‘এফ-১২ প্রোডাক্ট’ হিউম্যান ট্রায়ালেক প্রস্তুতিও চলছে বলে জানান ওই গবেষক।

খয়রাশোলের নাকড়াকোন্দা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইকোলজি ও প্লান্ট প্যাথোলজিতে মাস্টার্স এবং বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লান্ট প্যাথোলজিতে পিএইডি করার পরে বিদেশের বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরেছেন। তবে ক্যানসাররোধী ওষুধ তৈরির জন্য ওই বিশেষ ধরনের মাশরুম বাছার পিছনে রয়েছে তাঁর ছোটবেলার স্মৃতি।

স্বপনবাবুর গ্রামের বাড়ি খয়রাশোল থেকে নাকড়াকোন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার পথে তাঁদের ধানজমিগুলি শালজঙ্গল ও আদিবাসী পল্লি ঘেঁষা হওয়ায় কুড়কুড়ে মাশরুম তাঁর পরিচিত। আদিবাসীদের খেতে দেখেছেন, তিনি নিজেও খেয়েছেন। আদিবাসীদের মধ্যে ক্যানসার হওয়ার প্রবণতা কম, এটি জানার পরেই কুড়কুড়ে মাশরুম নিয়ে গবেষণার ভাবনা করেন তিনি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

khayrasole

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy