Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
self Help group

পড়শিদের অভাব ঘোচাচ্ছেন সন্তোষী

জেলা গ্রামোন্নয়ন দফতর গত বছরে তাঁদের সঙ্ঘকে ৪০ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়।

স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তৈরি জিনিসপত্র দেখছেন সঙ্ঘনেত্রী। নিজস্ব চিত্র

স্বনির্ভর গোষ্ঠীর তৈরি জিনিসপত্র দেখছেন সঙ্ঘনেত্রী। নিজস্ব চিত্র

প্রশান্ত পাল 
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২০ ০৩:০০
Share: Save:

সবাই মিলে চেষ্টা করলে কি অভাব ঘুচবে না? এই প্রশ্ন নিয়েই দোরে দোরে ঘুরে পড়শিদের ডেকে এনে একটা স্বনির্ভর দল গড়েছিলেন পুরুলিয়ার পাড়া ব্লকের শ্যামপুর গ্রামের বধূ সন্তোষী সিংহ। সে বছর দশেক আগের কথা। এখন তিনিই সঙ্ঘনেত্রী হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেউলি পঞ্চায়েতের ৩৮৪টি স্বনির্ভর দলকে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কলকাতার দক্ষিণাপনে গিয়ে ব্যবসা করছে সন্তোষীদেবীর সঙ্ঘ।

পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদারের কথায়, ‘‘উদ্যোগী থেকে উদ্যোগপতি হওয়ার পথে সন্তোষীদেবী পুরুলিয়ার স্বনির্ভর নারীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল মুখ। যে ভাবে তিনি লড়াই করে উঠে এসেছেন, তা অন্য স্বনির্ভর দলের মেয়েদের কাছে অনুপ্রেরণা।’’

আসানসোলের কোয়ারডি কোলিয়ারিতে বেড়ে ওঠা সন্তোষীর বিয়ে হয় ১৯৯৭ সালে। তাঁর কথায়, ‘‘একান্নবর্তী পরিবার যখন আলাদা হয়ে গেল, সেই সময়ে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর ডেকরেটর্সের ব্যবসা লাটে ওঠে। প্রশিক্ষণ থাকায় সাহস করে বিউটি পার্লার খুললাম। সঙ্গে টিউশন ও মুড়িভাজাও শুরু করি।’’

তাতে মন ভরেনি তাঁর। বড় কিছু করার ভাবনা থেকে সরকারি ঋণ পেতে এলাকার মেয়েদের ডেকে স্বনির্ভর দল গড়ে তোলেন। প্রশাসনের বিভিন্ন সভায় তাঁরা লুচি, তরকারি জোগান দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। এ ভাবে কিছু টাকা জমিয়ে তাঁরা ঋণের জন্য আবেদন করেন।

সন্তোষীদেবীর কথায়, ‘‘পুজোর মুখে দশ হাজার টাকা ঋণ পেলাম। দল থেকে টাকা ধার নিয়ে নিজের পার্লারের ব্যবসা বাড়ালাম। আর পিছনে

তাকাতে হয়নি।’’

তিনি জানান, দফায় দফায় ঋণ নিয়ে কখনও সেলাই করে পোশাকের ব্যবসা, কখনও অন্য টুকিটাকি কাজ শুরু করেন। নিজে সেলাই ও বিউটি পার্লারের প্রশিক্ষণ দিয়ে অন্য মেয়েদেরও দল তৈরিতে উৎসাহ দেন। প্রশাসনের নজরে আসায় তাঁকে সঙ্ঘনেত্রী করা হয়। সংসারের কাজেও তাঁর ফাঁকি নেই। নিজেই জানান, ভোরে রান্নাবান্না করে অসুস্থ স্বামীর দেখাশোনা, দুই ছেলেমেয়ের পড়াশোনাতে নজর রাখতে হয় তাঁকে।

জেলা গ্রামোন্নয়ন দফতর গত বছরে তাঁদের সঙ্ঘকে ৪০ লক্ষ টাকা অনুদান দেয়। সেখান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য গোষ্ঠীরাও তাদের ব্যবসা বাড়াতে শুরু করেছে। তাঁদের কাজকর্মের নিরিখে গত বছর পুজোর আগে জেলা প্রশাসন কলকাতার দক্ষিণাপনে ওই সঙ্ঘকে একটা বিপণি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। সন্তোষীদেবীরা তা লুফে নেন। সেখানেই এখন পুরুলিয়ার নিজস্ব ব্র্যান্ডের জিনিসপত্রের বেচাকেনা চলছে।

সন্তোষীদেবীর কথায়, ‘‘প্রশাসন আমাকে বিভিন্ন ব্লকে দলের মেয়েদের স্বনির্ভরতার প্রশিক্ষণ দিতে পাঠায়। সেই সুবাদে কোন ব্লকের কোন দল কী জিনিস ভাল তৈরি করে, তা জানা ছিল। সে সব কিনে কলকাতায় বিক্রি করছি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢেঁকিছাঁটা চাল, গুঁড়ো মশলা, মানভূম ডেয়ারির খাঁটি গাওয়া ঘি, ছৌ মুখোশ, বলরামপুরের গালার জিনিসপত্র, বীজকলম, শবরদের তৈরি কাশিঘাসের গৃহসজ্জার জিনিসপত্র, হাতে তৈরি খাদির পর্দা

ইত্যাদি।’’ পুরুলিয়ার খেজুরগুড় বিক্রি করেও তাঁরা ভাল লাভ করেছেন।

এখন সঙ্ঘের মূলধন ৬০ লক্ষ টাকারও বেশি। গত মার্চ মাস জেলায় স্বনির্ভর দলের মেয়েদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতা শোনেন রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব এম ভি রাও। জেলা প্রশাসনিক ভবন লাগোয়া স্বনির্ভর দলের জিনিসপত্র বিক্রির কয়েকটি বিপণির দ্বারোদ্ঘাটনের দায়িত্ব তিনি নিজের বদলে তিনি সন্তোষীদেবীর হাতে তুলে দেন। বলেছিলেন, ‘‘এই বিপণির সূচনা আপনাদের মত সঙ্ঘনেত্রীর হাত দিয়েই হবে।’’

সংসারে দারিদ্র ঘোচানোর পরে আরও একটি আক্ষেপ ঘুচতে চলেছে সন্তোষীদেবীর। লাজুক মুখে বলেন, ‘‘মাধ্যমিকের পরে পড়ার সুযোগ হয়নি। আগামী বছরে মেয়ের সঙ্গেই উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটাও আমরা একটা স্বপ্ন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE