রাজ্য সরকারের দাবি, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু— সব পর্যায়েই নানা জনকল্যাণমূলক প্রকল্প এনেছে তারা। কিন্তু তার সুবিধা পেতে প্রয়োজন আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, জাতিগত শংসাপত্র প্রভৃতি। পুরুলিয়া জেলায় সমাজের প্রান্তিক সম্প্রদায় শবর জনগোষ্ঠীর অনেকেরই ওই সব প্রয়োজনীয় নথি তৈরি হয়নি। ফলে তাঁরা সরকারি সুবিধায় বঞ্চিত হচ্ছেন। স্কুলে ভর্তি থেকে অন্য নানা কাজে বাধার মুখে পড়ছেন।
জীবনযাত্রার উন্নয়নের নিরিখে আদিবাসীদের মধ্যে পুরুলিয়ায় শবর ও বীরহোড় জনগোষ্ঠী একেবারে পিছনের সারিতে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এই জেলার ১৬৮টি টোলায় মোট ১৪,০৪০ জন শবর জনগোষ্ঠীর মানুষের বাস রয়েছে। তাঁদের মধ্যে আধার কার্ড নেই ২৭২৩ জনের (১৯%)। ফলে তাঁরা সমস্ত রকম সরকারি পরিষেবার বৃত্তের বাইরে থেকে গিয়েছেন।
এখানেই শেষ নয়। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ৫,৯৯৪ জনের (৪৩%) জাতিগত শংসাপত্র নেই। আদিবাসী পরিচয়পত্র না থাকায় তাঁরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা থেকে চাকরির পরীক্ষায় সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। সেই সঙ্গে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের আদিবাসীদের জন্য বিশেষ ভাতা থেকেও বঞ্চিত রয়েছেন। আদিবাসী বয়স্কদের পেনশন প্রকল্প ‘জয় জোহর’-এর সুবিধাও পাচ্ছেন না। না থাকার তালিকা আরো দীর্ঘ। ১,৬৪৭ জনের (১২%) ভোটার কার্ড না থাকায় তাঁদের ভোটাধিকার থাকে না।
রেশনের থেকে চাল, গম ইত্যাদিও অনেকে একই কারণে পান না। সমিতির দাবি, ৩,১০২ জন (২২%) শবর জনগোষ্ঠীর মানুষের কাছে রেশন কার্ডও নেই। ফলে তাঁরা রেশনের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। আবার রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও আধার কার্ড না থাকায় অনেকে রেশনও পান না।
আধার কার্ড, রেশন কার্ড, জাতিগত শংসাপত্র, ভোটার কার্ড না থাকায় শবর জনগোষ্ঠীর মানুষজন নানা সমস্যায় জেরবার। প্রশাসন কী করছে? পুরুলিয়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) সুদীপ পাল বলেন, ‘‘শবর সমিতির কর্তারা আমার অফিসে আসুন। যাঁদের আধার কার্ড এখনও হয়নি, কী ভাবে তা করা সম্ভব, আলোচনা করে দেখছি।’’
জেলায় শবর জনগোষ্ঠীদের নিয়ে অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে কাজ করছে পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি। কেন্দা থানার রাজনওয়াগড়ে সমিতির কেন্দ্রীয় অফিস রয়েছে। সেখানেও শবরদের অনেকে যোগাযোগ রাখেন। তারাও শবরদের উন্নয়নে নানা কর্মসূচি নেয়। তাহলে শবরদের কেন এই অবস্থা?
সমিতির সম্পাদক জলধর শবর ও সভাপতি রত্নাবলী শবর বলেন, ‘‘শবরদের জীবনে চাহিদা একেবারে কম। প্রকৃতির কোলে মানুষ হওয়ায় সাধারণত বনজ খাদ্যের উপরেই তাঁরা নির্ভরশীল। সচেতনতারও ঘাটতি রয়েছে। তবে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে সমিতি নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’’
সমিতির পরিচালক প্রশান্ত রক্ষিত বলেন, ‘‘প্রশাসনকে শবরদের যাবতীয় সমস্যার কথা বার বার জানানো হয়। প্রশাসনও বিভিন্ন সময়ে শিবির করে সমস্যাগুলো মেটানোর চেষ্টা করে। সমিতির কর্মীরাও শবর টোলায় গিয়ে শবরদের এই সব নথি করানোর জন্য বোঝান।’’ (চলবে)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)