Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

রোগ নির্ণয় হয়নি, হতাশ অসুস্থ শ্রমিকেরা

কনস বা মঙ্গলদের এই অসুখ সিলিকোসিস কি না তা জানতেই গত কয়েক বছরে বারবার কলকাতায় এসেছেন তাঁরা। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলেও রোগ নির্ণয় হয়নি। ফলে নিজেদের অসুস্থতা আর চিকিৎসার নামে এই উদাসীনতা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ শ্রমিকেরা বেঁকে বসেছেন সরকারী চিকিৎসা নিতে।

—প্রতীকী ছবি

—প্রতীকী ছবি

নিজস্ব সংবাদদাতা
সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৮ ০০:৩৮
Share: Save:

খাতায় কলমে পাথর খাদান বন্ধ। কিন্তু বাতাসে তার বিষ ছড়ানো। সেই মারণ বিষ প্রাণ কেড়েছে বীরভূমের তালবাঁধের মিছু মুর্মু, দেবু রাউত, বদন মুর্মুদের। শ্বাসকষ্ট আর বুকের অসুখে ভুগছেন দাশু মুর্মু, কনস টুডু, মঙ্গল হেমব্রম, গুপিন টুডুর মতো পাথর খাদানের অসংখ্য শ্রমিক। গত মাসে অসুস্থ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা ছিল কলকাতা সংলগ্ন বেলুড় ও জোকার ইএসআই হাসপাতালে। দিন নির্দিষ্ট করা থাকলেও কেউ আর অসুস্থ শরীরে কলকাতা পর্যন্ত যেতে চাননি।

কনস বা মঙ্গলদের এই অসুখ সিলিকোসিস কি না তা জানতেই গত কয়েক বছরে বারবার কলকাতায় এসেছেন তাঁরা। কিন্তু স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলেও রোগ নির্ণয় হয়নি। ফলে নিজেদের অসুস্থতা আর চিকিৎসার নামে এই উদাসীনতা নিয়ে বীতশ্রদ্ধ শ্রমিকেরা বেঁকে বসেছেন সরকারী চিকিৎসা নিতে। এই খবর জানার পরেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। বীরভূমের জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু কথা বলেন অসুস্থ শ্রমিকদের সঙ্গে। তাঁদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে সরকারী চিকিৎসা নিতে রাজি করান। ৯অক্টোবর কলকাতায় গিয়ে ইএসআই হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে রাজি হলেও দাশু বা কনসদের পরিবারের অভিযোগ, ‘‘এ ভাবে আর কতদিন? অসুখটা কি সেটা অন্তত স্পষ্ট করে জানানো হোক।’’ জেলাশাসক বলেন, ‘‘ওঁরা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কলকাতায় যেতে চাইছেন না জেনে আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। ইএসআই হাসপাতালকে বলা হয়েছে ওঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার সমস্ত রিপোর্ট জেলায় পাঠাতে। তবে এবার ওঁরা স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কলকাতা যাবেন বলে সম্মত হয়েছেন।’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, সিলিকোসিস এমন একটি রোগ যার মূলে আছে ক্রিস্টালাইজড সিলিকা বা স্ফটিকাকৃতির বালি বা পাথরের কণা। যেখানে এই ধরনের কণা উড়ছে দীর্ঘদিন সেখানে কাজ করলে ফুসফুসে মারাত্মক ক্ষতি হয়েই এই রোগ বাসা বাঁধে। পাথর খাদান, কাচ কারখানা, পাট কল, কংক্রিটের কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদেরই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সব থেকে বেশি সম্ভাবনা থাকে। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, আর সব শেষে শরীর নীল হয়ে যাওয়া এই রোগের লক্ষণ। সঠিক চিকিতসা না হলে পরিণতি মৃত্যু।

বীরভূমের পাঁচটি ব্লকে পাথর খাদান আছে। অভিযোগ, প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ছাড়াই ১০হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন এগুলিতে। ২০১২সালে পাথর খাদানের শ্রমিক মিছুর মৃত্যুর পরেই সিলিকোসিসের মতো মারণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার চিত্রটি স্পষ্ট হয়। যদিও মিছুর মৃত্যুর কারণ হিসাবে ধূলিকণাজনিত রোগের কথাই বলা হয়েছিল সেই সময়ে। সিলিকোসিসের কথা মানতে চাননি জেলার স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও। পাথর খাদানের দূষণ আর শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আন্দোলন করছেন আদিবাসী গাঁওতার সদস্যরা। আদিবাসী গাঁওতা নেতা রবীন সরেনের অভিযোগ, ‘‘এখন পরিবেশ আদালতের নির্দেশে ৯০শতাংশ খাদান কাগজে কলমে বন্ধ, অথচ কাজ চলছে। পেটের তাগিদে মানুষ কাজ করছেন। সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। কিন্তু মৃত্যুর কারণ হিসাবে ধুলোবাহিত রোগ লেখা হলেও বাস্তব অস্বীকার করা যায় না।’’

আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা মঙ্গল হেমব্রম ও সুকুমার সাহারা বলেন, ‘‘২০১১সাল থেকে পরিবেশ রক্ষা এবং শ্রমিক সুরক্ষার আন্দোলনের সময় মোট ৩৪জনকে আমরা শনাক্ত করেছিলাম, যাঁরা শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশিতে ভুগছিলেন। এমনকি যক্ষ্মার চিকিৎসাও হয়েছিল তাঁদের। তাতেও অসুখ সারছিল না। তাঁদের মধ্যে তিনজন ধুঁকে ধুঁকে মারা গেলেন। বাকিদের সিলিকোসিস হয়নি জানানো হলেও এখন ৭জনকে নিয়ে দোলাচলে সরকার। সরকারী খরচে বারবার কলকাতায় বেলুড় ও জোকা হাসপতালে পাঠিয়ে নানা পরীক্ষা নিরিক্ষা হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ওঁদের অসুখটা ঠিক কি সেটাই বলা হচ্ছে না।’’ স্থানীয়দের অভিযোগ, শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার টালবাহানায় সত্যিকে ধামাচাপা দেওয়া যায় না। বিশু মুর্মু ও কনস টুডুর অবস্থা সঙ্কটজনক বলেও জানান তাঁরা। পেশার কারণে শারীরিক ক্ষতি বা মারণ রোগে শ্রমিকদের আইনত ক্ষতিপূরণ এবং পূর্ণ বেতন-সহ চিকিৎসার পাওয়ার কথা। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় পাঠানো হলেও বাকি নির্দেশ না মানাই থাকছে বলেও অভিযোগ করেন অসুস্থ শ্রমিকদের পরিবারের লোকেরা। পাশাপাশি অভাবের সঙ্গেও লড়ছে পরিবারগুলি।

পাথর খাদান অবৈধ তকমা নিয়ে চলার ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের বালাই নেই ক্রাসার ও খাদান মালিকদের। অন্যদিকে, পাথর শিল্পাঞ্চল বাঁচাও কমিটির সম্পাদক কমল খান বলেন, ‘‘নিরাপত্তার বিষয়টি মানা হয় না এই অভিযোগ ঠিক নয়। হতে পারে সচেতনতার ঘটতি রয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। গত বুধবার মাইন সেফটি নিয়ে একটি বৈঠকও হয়েছে। জেলাশাসক বলেন, ‘‘সচেতনতা বাড়াতে কী করা যায় দেখছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Workers Mine Disease Silicosis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE