Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
উচ্চ মাধ্যমিকে ষষ্ঠ রামপুরহাটের ছেলে

টিভিতে নাম শুনতেই চোখে জল

ঘড়িতে তখন পৌনে ১টা। ফোনটা পেয়ে প্রথমে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাঁর! অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েই ফোনটা এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। চাপা টেনশন কাটিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল সৌমেন্দু মণ্ডলের! রামপুরহাট সাহাবাগান এলাকার গাঁধি পার্কের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা তথা স্থানীয় জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের ছাত্র সৌমেন্দুই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যে ষষ্ঠ স্থান পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কেমন লাগল?

মায়ের আদর। শুক্রবার রামপুরহাটে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

মায়ের আদর। শুক্রবার রামপুরহাটে ছবিটি তুলেছেন সব্যসাচী ইসলাম।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৫ ০১:৩১
Share: Save:

ঘড়িতে তখন পৌনে ১টা। ফোনটা পেয়ে প্রথমে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না তাঁর! অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েই ফোনটা এগিয়ে দিলেন ছেলের দিকে। চাপা টেনশন কাটিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল সৌমেন্দু মণ্ডলের!

রামপুরহাট সাহাবাগান এলাকার গাঁধি পার্কের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা তথা স্থানীয় জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের ছাত্র সৌমেন্দুই এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে রাজ্যে ষষ্ঠ স্থান পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কেমন লাগল? বিস্ময় যেন কিছুতেই কাটছে না সৌমেন্দুর। প্রশ্ন শুনে বলল, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি আমার সঙ্গে কথা বললেন, ভাবতেই কেমন লাগছে!’’ তাঁর পরেই বিদ্যাভবনের ছাত্রের সংযোজন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই ভাল ফল করার জন্য আমাকে আর বাবা-মাকে শুভেচ্ছা জানালেন। তিনিও বীরভূমের মেয়ে আর সেই জেলার ছেলে হয়ে এত ভাল ফল করার জন্য ওঁর খুব গর্ব হচ্ছে বলে জানালেন।’’ শুধু তা-ই নয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে চা চক্রে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণও জুটিয়ে ফেলেছে এই ছেলে!

সৌমেন্দুর প্রাপ্ত নম্বর ৪৮৫। বাংলায় ৯৪, ইংরেজিতে ৯৯, রসায়নে ৯৮, অঙ্কে ৯৯, পদার্থবিদ্যায় ৯৫ ও জীববিদ্যায় ৯৩ পেয়েছে সৌমেন্দু। সৌমেন্দুর বাবা লোকনাথ মণ্ডল নলহাটি বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক। এ দিন স্কুলের ফল তুলতে সকালেই রামপুরহাট হাইস্কুলে লাইন দিয়েছিলেন। তাঁর আগেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রামপুরহাট জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের এক শিক্ষাকর্মী। ওই কর্মী ফল তোলার আগেই লাইনের পিছনে থাকা লোকনাথবাবু স্ত্রী-র কাছ থেকে ফোন পেয়ে জানতে পারেন ছেলে রাজ্যে ষষ্ঠ হয়েছে! ছেলে ভাল ফল করবে জানতেন। তা বলে ষষ্ঠ হবে, ভাবতে পারেননি লোকনাথবাবু। উল্টো দিকে, বাড়ির টিভি-তে রেজাল্টের খবর দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের সচিব মহুয়া দাশগুপ্তের মুখ থেকে সৌমেন্দুর নাম শুনতেই তত ক্ষণে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন মা ও ছেলে। সৌমেন্দুর মা লক্ষ্মীদেবীর কথায়, ‘‘তখন দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপছি। আনন্দে চোখ ভিজে গেল।’’

“(তিনিও (মুখ্যমন্ত্রী) বীরভূমের মেয়ে আর সেই জেলার ছেলে হয়ে
এত ভাল ফল করার জন্য ওঁর খুব গর্ব হচ্ছে বলে জানালেন।”—সৌমেন্দু মণ্ডল।

এ দিকে, খবর ছড়াতেই লোকনাথবাবুর বাড়িতে তখন সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ভিড় করতে শুরু করেছেন। চিত্রগ্রাহকদের নানা আবদার মেটাতে মেটাতেই মিতবাক সৌমেন্দু বলল, ‘‘মন দিয়ে পড়াশোনা না করলে র‍্যাঙ্ক করাটা মুশকিল। তার জন্য যে নিয়ম বেঁধে একটানা লাগাতার পড়াশোনা করে যেতে হবে, তা অবশ্য নয়। কিন্তু যখন পড়ব, তখন শুধু পড়ার প্রতিই মনোযোগ দেওয়াটা দরকার।’’ সব বিষয়েই সৌমেন্দুর প্রাইভেট টিউটর দিতে হয়েছিল। বাবা অঙ্কের শিক্ষক, ছেলেও বিদ্যাভবনের মতো ভাল স্কুলের ছাত্র। তা সত্ত্বেও কেন টিউশন নিতে হয়েছে? সৌমেন্দুর ব্যাখ্যা, ‘‘টিউশন না পড়লেও চলবে। কিন্তু, স্কুলের ভিতরে এক জন শিক্ষক পড়ানোর জন্য খুব কম সময় পান। তাই কোনও একটি বিষয়ের গভীরে ঢুকে আলাদা করে তা নিয়ে পড়াশোনা না করলে এক জন পড়ুয়ার পক্ষে ভাল ফল করে র‍্যাঙ্ক করাটা মুশকিল।’’ তাই বলে স্কুলের পাঠ্যবই বাদ দিয়ে কোনও কিছুই সম্ভব নয় বলে তার দাবি। বাবা-মা, স্কুল ও প্রাইভেট শিক্ষকদের পাশাপাশি এই সাফল্যের পিছনে বন্ধুদের সঙ্গে পড়া নিয়ে আলোচনাকেও গুরুত্ব দিচ্ছে সৌমেন্দু। একই সঙ্গে সে গুরুত্ব দিচ্ছে উচ্চ মাধ্যমিকের নতুন পাঠ্যক্রমকেও।

ইতিমধ্যেই আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসার যোগ্যতা অর্জন করেছে সে। পলিটেকনিকের জেক্সপো পরীক্ষায় ১৬ র‌্যাঙ্কও করেছে। ভবিষ্যতে সিভিল বা ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়েই পড়তে চাই সৌমেন্দু। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সে রয়েছে। তবে, খুব বেশি ফলো করে না। ক্রিকেট খেলা ভাল লাগে। সৌমেন্দুর প্রিয় ক্রিকেটার এ বি ডেভিলিয়ার্স। ইন্টারনেটে তাঁর জীবনীও পড়ে ফেলেছে সে। অ্যাকশন এবং অ্যানিমেশম ফিল্ম দেখতে ভালবাসে। আর প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনীতির আকচাআকচি নাপসন্দ হলেও শিল্প ছাড়া রাজ্যের উন্নয়ন সম্ভব নয় বলেই মনে সৌমেন্দু। পাশাপাশি ধর্ষণ, খুনোখুনি বন্ধ হয়ে রাজ্যে সুশাসন হোক, এটাই কামনা করে। অত্যন্ত বিনয়ী ও লাজুক স্বভাব বলে পরিচিত এই ছেলের সাফল্যে গর্বিত পাড়া প্রতিবেশীও। এ দিনই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৌমেন্দুর বাড়িতে শুভেচ্ছা জানিয়ে গিয়েছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তপনকুমার ঘোষাল এবং আধিকারিক আব্দুর রেজ্জাক বিশ্বাস। স্কুলের প্রধান শিক্ষক গৌরচন্দ্র ঘোষ বলছেন, ‘‘এই ব্যাচের আরও কয়েকটি পড়ুয়াও এ বার র‍্যাঙ্ক করার মতোই ছিল। সৌমেন্দুর ফলে আমরা গর্বিত। আমরা ওর সাফল্য কামনা করি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE