Advertisement
০২ জুন ২০২৪

সালিশিতে ডেকে খুন ছাত্রকে, অভিযুক্ত ‘প্রেমিকা’র পরিবার

সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের মাশুল গুনতে হল নিজের প্রাণ দিয়ে। প্রেমিকার দাদার ভোজালির ঘায়ে মৃত্যু হল এক কিশোরের। বুধবার রাতে ঘটনাটি ঘটেছে বাঁকুড়ার খয়েরবনি গ্রামে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত ওই কিশোরের নাম শেখ মোমিন (১৮)।

নিহত শেখ মোমিন আলি।

নিহত শেখ মোমিন আলি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:৫৫
Share: Save:

তারা পড়শি। তারা সহপাঠী। তাদের মধ্যে ছিল প্রেমও।

কিন্তু, একই পাড়ার এই দুই স্কুলপড়ুয়ার সম্পর্ক নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে অশান্তি চলছিল। তা নিয়ে মীমাংসার জন্য গ্রামেই সালিশি সভা ডেকেছিলেন মেয়ের বাড়ির লোকজন। সেই সভা শুরুর আগেই ‘প্রেমিক’ পড়ুয়াকে ভোজালির কোপ মেরে খুনের অভিযোগ উঠল ‘প্রেমিকা’র দাদা-সহ বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে। বাঁকুড়ার রাইপুর থানার খয়েরবনি গ্রামে বুধবার রাতের এই ঘটনায় নিহতের নাম শেখ মোমিন আলি (১৮)। এলাকায় উত্তেজনা থাকায় গ্রামে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। নিহতের বাবা বৃহস্পতিবার ছেলের ‘প্রেমিকা’-র বাবা নৌশাদ আলি, মা নাসিমা বেগম, দাদা তেজাব আলি-সহ ১১ জনের নামে খুনের অভিযোগ অভিযোগ দায়ের করেন। সন্ধ্যায় পুলিশ নাসিমাকে আটক করেছে।

বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীরকুমার বৃহস্পতিবার বলেন, “প্রেম ঘটিত কারণের জন্যই ওই পড়ুয়াকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে।’’

পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর থানার সীমানা ঘেঁষা খয়েরবনি গ্রাম। বাসিন্দাদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রামেরই বাসিন্দা হুরমত আলির বড় ছেলে মোমিনের সঙ্গে পড়শি নৌশাদ আলির মেয়ের ‘প্রেম’ ছিল। তারা দু’জনেই স্থানীয় হাইস্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত। মেয়েটির পরিবার এই সম্পর্ককে ভাল চোখে দেখেনি। ওই দুই পরিবারের মধ্যে অন্য কিছু বিষয় নিয়েও বিবাদ ছিল। মোমিনের বাড়ির লোকের দাবি, দিন কয়েক আগে মেয়েটির দাদা তেজাব মোমিনকে শাসানিও দিয়েছিল। গ্রামের লোকের উপস্থিতিতে একটা ফয়সালা করার জন্যই বুধবার রাতে পাড়ায় সালিশি সভা ডেকেছিল মেয়েটির পরিবার। অভিযোগ, রাত আটটা নাগাদ সালিশি সভা শুরুর আগে মোমিনকে বাড়ি থেকে ডেকে পাঠানো হয়। সভা বসার আগে অতর্কিতে মোমিনের পিছনে ভোজালির কোপ মেরে পালায় তেজাব। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে গ্রামের মানুষ রাইপুর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই তার মৃত্যু হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঘটনার সময়ে উপস্থিত এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, মোমিনের সঙ্গে মেয়েটির প্রেম নিয়ে তেজাব ও তার বাবা-মায়ের ঘোর আপত্তি ছিল। তাই মোমিনকে সবার সামনে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যই সালিশি সভা ডেকেছিলেন মেয়েটির বাবা, দাদারা। ওই প্রত্যক্ষদর্শীর দাবি, “রাত তখন আটটা হবে। সভার আশেপাশে লোকজন জড়ো হচ্ছে। সভায় আসার জন্য মোমিনের বাড়ির লোকজনকে ডাকা হয়। মোমিন এসে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখি চিৎকার করে মোমিন পড়ে গেল। তেজাব ও তার মা, বাবা, কাকারা ছুটে পালাচ্ছে। মোমিনের সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে।’’

ফুলকুসমা থেকে বক্সি হয়ে বিনপুর যাওয়ার রাস্তায় খয়েরবনি গ্রাম। বৃহস্পতিবার সকালে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছেন গ্রামবাসীরা। প্রকাশ্যে ওই ঘটনা নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি। তবে, মোমিনকে খুনের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসছেন অধিকাংশ বাসিন্দা। নিহতের বাড়ির অদূরে বিশাল পুলিশবাহিনী। বাড়ির ভিতর থেকে মহিলাদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। যদিও সেখানে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের না ঢোকার জন্যই অনুরোধ করলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযুক্তদের বাড়ি তালাবন্ধ। ঘটনার পর থেকেই বেপাত্তা তাঁরা।

বিনপুরের শিলদায় মোমিনের বাবা হুরমত আলির জুতো পালিশের দোকান রয়েছে। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছিল মোমিন। হুরমত এ দিন বলেন, “মোমিনের সঙ্গে ওই মেয়ের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তা আগে আমি জানতাম না। কিছুদিন আগে শুনে ছেলেকে বকাঝকা করেছিলাম। তবে, ওরা (তেজাবের পরিবার) প্রথম থেকেই মোমিনকে শাসানি দিচ্ছিল। আমিও চেয়েছিলাম, এর একটা বিহিত হোক। তাই ওরা গ্রামে আলোচনার জন্য আমাদেরকে ডেকে পাঠানোয় আমি আপত্তি করিনি। কিন্তু, তার পরিণতি যে এমন ভয়ঙ্কর হবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি!’’ তাঁর অভিযোগ, মোমিনের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের প্রেম তেজাবরা কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারেনি। তাই সালিশি সভার নাম করে তাঁর ছেলেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে নৌশাদ আলি, মা নাসিমা বেগম, দাদা তেজাব, কাকা আজাদ আলি, রফিক আলি-সহ কয়েক জন পরিকল্পনা করে খুন করেছে।

খয়েরবনি গ্রামটি যে পঞ্চায়েতের অন্তর্গত, সেই ঢেকো পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান সন্ধ্যা সোরেনের দাবি, “এমন সালিশিস ভার কথা আমি শুনেছি ওই ঘটনার পরে। আমরা এমন নৃশংস কাজকে কোনও ভাবেই সমর্থন করি না। তবে যতদূর জানি, ছেলেমেয়ের প্রেম নিয়ে পারিবারিক হিংসার জেরে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। পঞ্চায়েতের কোনও সদস্যও সভায় ছিলেন না বলেই জানি।’’ খয়েরবনির পঞ্চায়েত সদস্য কাপুরমণি মুর্মু বলেন, “ওই সালিশি সভার কথা জানতাম না। জানলেও যাওয়ার প্রশ্ন ছিল না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE