চলছে পাইপ বসানোর কাজ। — নিজস্ব চিত্র।
ছাতিফাটা গরমে বাড়ন্ত তেষ্টার জল!
জলের জন্য রাস্তার দু’ধারের ট্যাপকলের গোড়ায় দীর্ঘ লাইন। হাতে কলসি-বালতি নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি। এ সব ছবি সাঁইথিয়ার অধিকাংশ পাড়ার নিত্য দিনের ঘটনা। জল-জল করে পড়শিদের সঙ্গে বচসা মায় হাতাহাতি, তা থেকে থানা-পুলিশ— এ সব ঘটনারও সাক্ষী এই শহর।
একটা সময় শহরের লোকজন মূলত কুয়ো, পুকুর এবং ময়ূরাক্ষী নদীর আশপাশের বাসিন্দারা নদীর উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু গরমের সময় অধিকাংশ কুয়ো, পুকুর শুকিয়ে যায়। খরাশ্রোতা ময়ূরাক্ষী এখন যেন ধূ ধূ মরু চড়! এই সমস্যার প্রধান কারণ, মাটির নীচে খড়িমাটি ও পাথর থাকায় এখানে সাধারণ টিউবওয়েলে জল ওঠে না। ফলে শহরের অধিকাংশ পরিবার বা লোকজন পুরসভা নিয়ন্ত্রিত ট্যাপ বা টাইম কলের জলের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু, তা নিয়েও বিস্তর অভিযোগ।
জল সমস্যা দূর করতে ১৯৭১ সালে জেলার বাণিজ্যকেন্দ্র সাঁইথিয়ায় প্রথম জল প্রকল্প গড়ে ওঠে। তৈরি হয় ৬০ হাজার গ্যালনের জলাধার। এটি ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। সময়ের সাথে সাথে শহরে লোকসংখ্যা বাড়ে। ১৯৮৭ সালে ১১ নম্বর ওয়ার্ডের পুরসভা চত্বরে এক লক্ষ গ্যালনের দ্বিতীয় জলাধার নির্মিত হয়। দুটি জলাধার থেকে সারাদিনে দু’বার, সকালে ও বিকালে জল দেওয়া হয়।
স্থানীয় ও পুরসভা সূত্রে জানা যায়, দু’বারে যা জল দেওয়া হয় তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। কখনও কখনও আবার কল খোলার অনেক পরে জল দেওয়া হয়। গোল বাধে সে সময়েই। আরও অভিযোগ, সুতোর মতো সরু জল পড়ে। বালতি ভরতেও সময় লেগে যায়।
পুরসভা সূত্রে জানা যায়, ওই দুটি জলাধার থেকে এই মুহূর্তে শহরে জলের পাইপ লাইন আছে ২৫ কিলোমিটার। ট্যাপকলের সংখ্যা যথাক্রমে রাস্তায় ৫৫০ ও ঘরোয়া সংযোগ ৪৪০। মোট ৯৯০। কিন্তু জনবসতি বেড়ে যাওয়ায় তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে জল সমস্যা চরম আকার নেয়। তা দূর করতে সাঁইথিয়া পুর কর্তৃপক্ষ শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ৩২টা সাবমার্শিবল কল বসায়। স্থানীয়দের কথায়, ‘‘তাতে সমস্যা কিছুটা দূর হয় ঠিকই, কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা-ও অপ্রতুল।’’
পরিস্থিতি দেখে ২০০৯ সালে কংগ্রেস পরিচালিত সাঁইথিয়া পুরসভার আবেদনে সরকার ‘ইউআইডিএসএসএমটি’ প্রকল্পে ১৩ কোটি টাকা অনুমোদন করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অবশ্য অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই সাঁইথিয়ায় জল প্রকল্পের কথা শুনে আসছি। এমনকি পুর নির্বাচনের আগে সব দলের পক্ষ থেকেই বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হত। কিন্তু তা আজও বাস্তবে রূপায়িত পায়নি। ফলে অধিকাংশ এলাকায় জল নেওয়ার জন্য বালতি কলসির লাইন পড়ে যায়। তবে কয়েক’টি পাড়ায় ‘ডিপ টিউবওয়েল’ বসানোয় কিছুটা সমস্যা মিটেছে।
কবে হবে জল প্রকল্পের কাজ?
পুরসভা সূত্রের খবর, নতুন প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের মুখে। ব্যস্ত এলাকায় রাস্তায় দিনে পাইপ বসানোর কাজ করার অসুবিধে। তবু দিনে রাতে সমান ভাবে জল প্রকল্পের কাজ চলছে। দীর্ঘ দিন আগের ঘোষিত জল প্রকল্পে এত দিন তেমন ভাবে কাজ না হলেও এ বার যে কাজে গতি এসেছে তা স্থানীয় লোকজনের কথাতেই পরিস্কার। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মিলি মাহান্ত দে, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বিজলি গুহ, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের উজ্জ্বল ঘোষ, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ফটিক মণ্ডল, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাদল ভকতরা বলেন, ‘‘গত কয়েক মাস ধরে দেখছি দ্রুত গতিতে কাজ চলছে। মনে হয় এ বার সত্যি সত্যি জল প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।’’
পুরসভা সূত্রের খবর, জলাধারের কাজ অনেক আগে শুরু হলেও পাইপ লাইনের কাজ শুরু হয় গত বছর ১৬ জুন। এই জল প্রকল্পে নতুন করে দুটি জলাধার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষের দিকে। একটি ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের আশ্রমপল্লির কাছে ৫.৬৭ লক্ষ লিটারের, অপরটি ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবপুরে ২.২৭ লক্ষ লিটারের। জলের জোগান দেওয়া হবে পাঁচটি সাবমার্শিবল পাম্প থেকে। ৪৯.৫ কিলোমিটার জলের নতুন পাইপ লাইন বসছে। প্রকল্পের সমস্ত কাজই প্রায় শেষের দিকে। সব ঠিকঠাক থাকলে চলতি বছরের জুন-জুলাই মাসের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
পানীয় জলের স্থায়ী সমাধান কবে? পুরপ্রধান বিপ্লব দত্তের কথায়, গত বোর্ডের সময় এই জল প্রকল্পের অনুমোদন মিলেছিল এটা ঠিক। কিন্তু নিয়মানুযায়ী এই জল প্রকল্পে ৮০ শতাংশ কেন্দ্র, ১৫ শতাংশ রাজ্য ও ৫ শতাংশ সংশ্লিষ্ট পুরসভার দেওয়ার কথা। সে সময় রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিপ্লববাবুর অভিযোগ, ‘‘কংগ্রেস পরিচালিত পুরসভা হওয়ার কারণে বিমাতৃসুলভ আচরণ করেছে বাম সরকার। সেই কারণেই জল প্রকল্প সহ অনেক কাজ থমকে ছিল।’’ তৃণমূলের সরকার আসার পরে কাজ এগোয় বলে তাঁর দাবি। তাঁর আশ্বাস, ‘‘সব ঠিকঠাক চললে এ বছর জুন জুলাইয়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন বাড়ি বাড়ি জলের সংযোগ দেওয়া হবে। রাস্তার কলের টাইম কলের সংখ্যাও বেড়ে যাবে।’’
সেই আশ্বাসের দিকেই চেয়েই শহরবাসী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy