অল্প বয়সে বিয়ে বন্ধ করতে মেয়েদেরই এগিয়ে আসার বার্তা নিয়ে চলছিল নাটক। মাঝে মধ্যেই পালা থামিয়ে কুশীলবরা দর্শকদের মতামত জানতে চাইছিলেন। এ ভাবেই এগোচ্ছিল নাটক।
হঠাৎ ছন্দপতন। দর্শকদের মতামত জানতে চাওয়ায় আসরের মাঝখান থেকে এক কিশোরী হাত তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু মেয়ে মুখ খোলার আগেই দর্শকদের মাঝ থেকে তার বাবা লাফ দিয়ে ছুটে আসেন। মেয়ের চুলের মুঠি ধরে তিনি বলতে থাকেন, ‘‘খুব সেয়ানা হয়েছিস না! তোকে আর নাটক দেখতে হবে না। ঘরে চল, দেখাচ্ছি মজা।” আসরের মাঝখানেই মেয়ের পিঠে তিনি কয়েক ঘা বসিয়েও দেন। কিশোরী কাঁদতে কাঁদতে বাবার সঙ্গে বাড়ি চলে যায়। হট্টগোলে নাটক সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়।
ঘটনাস্থল সেই পুরুলিয়া জেলা, যা বাল্যবিবাহ রোধ আন্দোলনে এ রাজ্যের পাশাপাশি সারা দেশকে পথ দেখিয়েছে। সম্প্রতি সেই পুরুলিয়ারই বরাবাজার থানার বনকাটি গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেছে। সে দিনই নাট্যদলের কর্মীরা ওই কিশোরীর বাবার বিরুদ্ধে থানায় মেয়ের বাক্ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ও মারধরের অভিযোগ করেছেন। যদিও এখন সেই কিশোরীর বাবা মেয়েকে ওই ভাবে মারধর করার জন্য আফসোস করছেন।
বরাবাজার থানা এলাকার ‘সবুজ সাথী নারী সঙ্ঘ’ নামের একটি সংস্থা মেয়েদের বিভিন্ন প্রকল্প সম্পর্কে প্রচার ও নারী চেতনার কাজ করে। তারাই নিজেদের লেখা নাটক ওই গ্রামে সে দিন সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ করতে যায়। ওই নাট্যদলের সদস্য সন্ধ্যা ষড়ঙ্গী, চিন্তামণি কুমার জানান, তাঁদের কয়েকটি নাটকের মধ্যে ‘এই সমাজের কেমন বিচার’ নাটকটির চাহিদা বেশি। এতে কম বয়সে বিয়ে বন্ধ করার বার্তা রয়েছে। জানানো হয়েছে, অল্প বয়সে বিয়ে দিলে মেয়েদের শারীরিক দূর্বলতা আসে, শরীর ভেঙে যায়। ঠিকমতো সন্তান পালন করতেও তাঁরা পারে না। এ ছাড়া আরও নানারকম জটিলতা ঘিরে ধরে।
সে দিন কী হয়েছিল? তাঁদের কথায়, “সে দিন বনকাটি গ্রামে দর্শকদের মধ্যে সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া ওই কিশোরী আমাদের কিছু বলতে উঠেছিল। কিন্তু তার বাবা বলতেই দিল না। উল্টে আসরের মধ্যেই মেয়েকে তিনি মারধর করলেন। আমরা প্রতিবাদ করায় তিনি আমাদের ওপরেও চোটপাট করেন। পরে অন্য দর্শকরা প্রতিবাদ করায় তিনি মেয়েকে নিয়ে চলে যান।” তাঁদের মতে, ওই ব্যক্তি মেয়ের বাবা বলে তো মেয়েটির মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না! নাটকে যেখানে মেয়েদের উপর নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, সেখানে সবার সামনে মেয়েকে মেরে তিনি ঠিক কাজ করেন নি। তাঁদের দাবি, ওই ঘটনার জন্য কিশোরীর বাবাকে ভুল স্বীকার করতে হবে।
কী বলতে চেয়েছিল সেই মেয়ে? বন্ধুদের সঙ্গে টিউশন নিতে এসে বাড়ির লোকেদের আড়ালে সেই মেয়ে বলে, “নাটকটা দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। নাটকে আমাদের মতো মেয়েদের কথা বলা হয়েছে। কম বয়েসে মেয়েদের বিয়ে দিলে কী কী অসুবিধা হয়, সে সব কথা বলা হচ্ছিল। আমি তাই অন্য যে সব গ্রামে আমার বন্ধুরা থাকে, সেখানেও ওই নাটক করার জন্য ওঁদের বলতে চেয়েছিলাম।” সে জানায় ওই ঘটনার পরে অবশ্য বাবা তাকে আর কিছু বলেনি।
ওই কিশোরীর বাবা পেশায় কৃষিজীবী। তিনি এখন অবশ্য সে দিনের ঘটনার জন্য অনুতপ্ত। তিনি বলেন, “গ্রামের মেয়েরা এ ভাবে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বললে মেয়ের সম্পর্কে গ্রামবাসীর বিরূপ ধারণা হবে। পরে হয়তো এ জন্য ওর বিয়ে দেওয়া মুশকিল হতে পারে। এ কারণেই আমি মেয়েকে শাসন করেছিলাম।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “তবে ওই দিন সবার সামনে মেয়ের গায়ে হাত তোলাটা আমার ঠিক হয়নি। আসলে অত লোকের মাঝখানে ওই ভাবে মেয়েকে দাঁড়াতে দেখে আমার রাগ চেপে গিয়েছিল। এখন খারাপ লাগছে।”
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও এই এলাকায় কম বয়েসে অনেক মেয়েরই বিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় শাঁখারি বাঁশবেড়িয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দ্রকান্ত মাহাতো বলেন, “কম বয়েসে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু এখনও এলাকায় কম বয়েসে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
নাটক দলের কলাকুশলীরা সকলেই মহিলা। অভিনেত্রী শিখারানি মাহাতো, সানু বিবি, গুরুবারি মাঝি বলেন, “বিভিন্ন গ্রামে নাটক প্রদর্শনের পর অনেক সময় কিশোরী মেয়েরা লুকিয়ে আমাদের সাথে দেখা করে তাদের ভালো লাগার কথা জানায়। ওরা জানায়, মেয়েদের জন্য এত সরকারি সুযোগ ও আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, তা আগে জানত না।” তাঁদের মতে, শুধু আইনে হবে না। মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য একে সামজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। নাটকের মধ্যে তাঁরা সেই বার্তাই দিচ্ছেন।
বার্তা যে ছড়াচ্ছে, প্রত্যন্ত গ্রামের ওই মেয়েটির ভিড়ের মধ্যে নিজের মতপ্রকাশের জন্য মাথা তুলে দাঁড়ানোই তার প্রমাণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy