ভোর থেকে রাত পর্যন্ত বাসে-বাসে বই ফেরি করে দিনে মেরেকেটে ১০০ টাকা রোজগার হয়। কোনওরকমে দু’বেলা ভাতটুকু জোটে। এক বছর হল বিয়ে হয়েছে। বেড়াতে যাওয়ার জন্য স্ত্রী প্রায়ই জেদাজেদি করেন। টাকার অভাবে তাও হয়ে উঠছে না।
আর্থিক অনটনের মধ্যে থেকেও বাসের আসনের নীচ থেকে টাকা ভর্তি খাম কুড়িয়ে পেয়ে বাস শ্রমিকদের অফিসে জমা দিয়ে সততার নজির তৈরি করলেন বাঁকুড়া গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডের ওই ফেরিওয়ালা মানস কুণ্ডু। শুক্রবার সকালে ওই ঘটনার খবর পেয়ে বাসস্ট্যান্ডে তাঁকে দেখতে রীতিমতো ভিড় জমে যায়। ওই বাস শ্রমিক সংগঠনের তরফে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়।
গঙ্গাজলঘাটির নতুন গ্রামের বাসিন্দা মানস কুণ্ডু প্রতিদিনের মতোই শুক্রবারও ভোর সাড়ে ৫টায় বাড়ি থেকে বই বিক্রি করতে বেরিয়েছিলেন। বাঁকুড়ায় এসে গোবিন্দনগর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা আসানসোল-খাতড়া বাসে ওঠেন। উঠেই বাসের ডানদিকের একটি আসনের নীচে পড়ে থাকতে দেখেন সাদা খাম। সন্দেহ হয় তাঁর। কাছে গিয়ে দেখেন একটি ৫০০ টাকার নোটের কিছুটা খাম থেকে বেরিয়ে আছে। খামের মুখ খুলেই তাজ্জব হয়ে যান। ভিতরে যে অনেক টাকা! কর্তব্য তখনই ঠিক করে নেন। খাম হাতে নিয়ে সোজা হাঁটা দেন বাঁকুড়া জেলা বাস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের অফিসের দিকে। অফিসে ঢুকে টাকা ভর্তি খামটি জমা দিয়ে ঘটনার কথা বাস কর্মীদের তিনি জানান। তাঁর সততা দেখে তাজ্জব বনে যান অফিসের কর্মীরা। খবর পেয়ে চলে আসেন ওই শ্রমিক সংগঠনের সভানেত্রী অলকা সেন মজুমদারও। মানসবাবুকে দেখতে ভিড় জমে। খাম খুলে দেখা যায় মোট ১৪ হাজার টাকা। অলকাদেবী পুলিশকে ফোন করে ঘটনার কথা জানান। পুলিশ আপাতত টাকা ওই অফিসেই রাখতে বলেছেন। মানসবাবু টাকা ফিরিয়ে দিলেও ওই টাকা নিজেদের বলে দাবি করে দুপুরের মধ্যেই অনেকে পুলিশের কাছে উপস্থিত হন। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ দেখাতে না পারায় টাকা কারও হাতেই তুলে দেয়নি পুলিশ। তবে মানসবাবুর সততা সবার প্রশংসা পাচ্ছে। বাসস্ট্যান্ডের ভাড়াগাড়ির চালক বাপি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “একজন ব্যতিক্রমী মানুষের পরিচয় দিয়েছেন মানসবাবু। তাঁকে যোগ্য সম্মান দেওয়া উচিত।” বাসযাত্রী নেপাল প্রামাণিক বলেন, “১৪ হাজার টাকা কম নয়। অভাবী হয়েও সেই টাকা কুড়িয়ে পেয়ে ফিরিয়ে দিয়ে প্রকৃত মানুষের মতো কাজ করলেন ওই বই বিক্রেতা।”
মানসবাবুর এই কাজের খবর গিয়েছে বাঁকুড়া সদর মহকুমাশাসক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের কাছেও। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “দৃষ্টান্তমূলক কাজ করেছেন ওই ব্যক্তি। এই ধরনের সততা এখন খুব কমই চোখে পড়ে।” যাঁকে নিয়ে এত কথা তাঁর অবশ্য বসে থাকার উপায় ছিল না। এত সবের পরেও একই রকম নির্বিকার মানসবাবু। কিছুক্ষণ বাস কর্মীদের অফিসে বসে থাকার পরে ফের বই বিক্রি করতে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। বাসে বই ফেরি করতে করতে তিনি বলেন, “অন্যের টাকায় আমার কোনও লোভ নেই। গতর যতদিন আছে খেটে রোজগার করব।” দিনের শেষে তিনি কত রোজগার করে আনেন সেই দিকেই তাকিয়ে থাকেন তাঁর বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী। তাই লোকের প্রশংসা কুড়োতে বসে থাকার যে জো নেই।
রোদ-ক্লান্ত মুখে মানস তাঁর স্বপ্নের কথা জানাতে ভুললেন না। “এক দিন বউকে ঠিক ঘুরতে নিয়ে যাব। তবে নিজের রোজগারে। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে যতই খিটিমিটি হোক, আমি জানি স্ত্রী রুম্পাও আমার পরিশ্রমের টাকাতেই ঘুরতে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে!”