নেই রাজা, নেই রাজ্যপাট। পড়ে রয়েছে রাজবাড়ির এই স্মৃতি চিহ্ন। ছবি তুলেছেন উমাকান্ত ধর।
চারপাশে জঙ্গল। দু’পাশ দিয়ে ঘিরে রেখেছে তিনটি নদী কংসাবতী, ভৈরববাঁকি ও তারাফেনি। শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এমনই জায়গায় কয়েকটি গড় তৈরি করেছিলেন রাজারা। ইতিহাসের বহু স্মৃতি নিয়ে এখনও জেগে রয়েছে ওই জনপদ রাইপুর।
সময়ের আঘাতে অতীতের সেইসব গড় এখন আর টিকে নেই। রাজা মহারাজারাও অতীত। নেই কারও জমিদারি। ‘গড়রাইপুর’-এর নাম থেকে ‘গড়’ শব্দ খসে গিয়ে এখন রয়েছে শুধু ‘রাইপুর’। এক সময়ের জঙ্গলে ঘেরা এই জনপদের বুক চিরে চলে গিয়েছে পিচ ঢালা সড়ক বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়ক। বাড়ছে পাকাবাড়ি, তৈরি হয়েছে মার্কেট কমপ্লেক্স, অতিথি আবাস। রাইপুরের এই বর্তমান ছবি জানিয়ে দিচ্ছে একসময়ের তুঙ্গভূমি, শিখরভূমি বদলে গিয়েছে।
এই বদলে যাওয়ার পূর্বে কেমন ছিল গড়রাইপুর? কাদের রাজত্ব ছিল এখানে? এ সব জানার জন্য অবশ্য সময়ের সরণিতে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় ৫০০ বছর। ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা জানাচ্ছেন, কাঁসাই নদীর তীরে তখন এই এলাকার নাম ছিল শিখরভূম ও তুঙ্গভূম। কথিত রয়েছে, দক্ষিণ বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে একসময় শিখর ও তুঙ্গ পদবিধারী দু’টি রাজ পরিবার রাজত্ব করেছেন। ও’ম্যালির গেজেটিয়ারে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মোঘল আমলে রাজপুতানা থেকে চৌহান বংশীয় এক রাজপুত ভাগ্যান্বেষী গড় রাইপুরে এসেছিলেন। তিনি ‘শিখররাজা’ উপাধি নিয়ে এখানে বসতি স্থাপন করেন। এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন মিরণশাহ। তিনি ছিলেন বিষ্ণুপুরের কুরমান শাহের মতোই সশস্ত্র বাহিনীর ফকির নায়ক। প্রজাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন সন্ত। তাঁর আমলে এই অঞ্চলে মরাঠা আক্রমণ হয়। মরাঠীদের সঙ্গে যুদ্ধে শিখর রাজা মিরণশাহ প্রাণ হারান।
এই জনপদের মধ্যেই শিখরগড় নামে একটি প্রাচীন দুর্গ ছিল। সেই দুর্গের পাশেই ছিল এক গভীর দিঘি, রাজপ্রাসাদ ও মন্দির। ওই দিঘির পূর্বপারে রয়েছে ‘মিরণ শাহের সমাধি’। শিখর রাজ বংশের অবসানের পর রাজপুরোহিত রাজদণ্ড হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। তবে তাঁর শাসনকেন্দ্র ছিল রাইপুরের পাশে ‘গুরুপাড়া’ (বর্তমানে যা গুড়েপাড়া নামে পরিচিত) এলাকায়। তাঁর রাজত্ব ছিল ক্ষণস্থায়ী। কিছুদিনের মধ্যেই মল্লরাজা কৃষ্ণ সিংহের ছোট ভাই ফতে সিংহ বরাহভূম রাজার সাহায্যে রাজপুরোহিতের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে রাইপুরে বসবাস শুরু করেন। তিনি আগে বিষ্ণুপুর থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ফতে সিংহ মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকে রাজসনদ পান।
বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটের তথ্য অনুযায়ী, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে রাইপুরের জমিদার পরিবার অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। গিসবন কোম্পানি এই জমিদারির ইজারা নিয়ে নেয়। ১৮০৫ সালে জঙ্গলমহল জেলা গঠিত হয়। পরে ১৮৩২ সালে এই জেলা অবলুপ্ত হয়। ১৮৫৭ সালে রাইপুর প্রথমে মানভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৮৭৯ সালে মানভূম জেলা থেকে যে সব এলাকা বাঁকুড়া জেলায় স্থানান্তরিত হয় তার মধ্যে ছিল রাইপুর। গড় রাইপুর, নতুনগড়, ধরমপুর, ধোবাশোল, কামারডিহা, বনপাথরি, নীলজোড়া, সিমলি, উপরবাঁধা, দুবনালা, কেলেপাড়া, খড়িগেড়্যা, যাদবনগর, যশপাড়া, দেমুশন্যা-সহ ২৭টি মৌজা নিয়ে গঠিত ছিল ফতে সিংহের বংশধর রাজা দুর্জন সিংহের জমিদারি। চুয়াড় বিদ্রোহের সময়ে দুর্জন সিংহকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে ১৭৯৯ সালের ২০ নভেম্বর বৃটিশ সরকার সমঝোতা করে। দুর্জন সিংহকে মুক্তি দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে দুর্জন সিংহের বড় ছেলে ফতে সিংহের হাতে জমিদারির অধিকার পুনরায় প্রত্যাপর্ণ করা হয়। এরপর ঋণের দায়ে জর্জরিত রাইপুর জমিদারির হস্তান্তর ঘটে ১৯১৩ সালে। পরে এই পরগনার জমিদারি দ্বারভাঙা মহারাজের অধীনে ন্যস্ত হয়।
রাইপুরের নাম নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। লোকসংস্কৃতি গবেষক তথা বাঁকুড়া খ্রিস্টান কলেজের অধ্যাপক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “রাইপুরের প্রাচীন নাম ছিল ধরমপুর। পরে রাজাদের কুলদেবী ‘রাই’ এর নাম অনুসারে ওই জনপদের নাম রাইপুর হয়েছে। আকবরনামায় এর নাম ‘রায়পুর’ রয়েছে। তখন রায়পুর সরকার জল্লেশ্বরের (অধুনা ওড়িশা) অন্তর্গত ছিল।”
এলাকার প্রবীণ মানুষেরা জানিয়েছেন, নতুনগড়ে রাজা দুর্জন সিংহের কাছারিবাড়ি ছিল। সেখানে ছিল প্রকাণ্ড একটি দুর্গ। রাইপুরের পার্শ্ববর্তী সারংগড়ে একটি দুর্গ ছিল। পরবর্তীকালে সেই দুর্গ অবশ্য মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছে। নতুনগড়ে বর্তমানে গড়ে উঠেছে রাইপুর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। রাইপুর ব্লক অফিস যেখানে তৈরি হয়েছে সেটিও পূর্বে রাজাদেরই ছিল। পরে তা সরকারের কাছে হস্তান্তর হয়। রাইপুরের অধিষ্ঠাত্রী ‘কোকামুখা’ দেবী মহামায়া। আলমসায়রের পাড়ে চাঁদুডাঙায় রয়েছে দেবী মহামায়ার মন্দির। প্রচলিত মতে, রাইপুরের দেবী চণ্ডী ছিলেন আদিতে একটি শিলাখণ্ড, পরে তাতে মা মহামায়ার আগমন ঘটে। যদিও এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। দেবী মহামায়ার মূর্তি অথবা পুরনো গড়ে শেষ রাজবংশের স্মৃতি বিজড়িত ভগ্নপ্রায় প্রাসাদ প্রমাণ দিচ্ছে, এক সময় জঙ্গলমহলের এই এলাকায় রাজাদের ‘গড়’ (দুর্গ) ছিল। আর দেবী মহামায়ার প্রস্তর মূর্তি প্রমাণ করে এই নগর সভ্যতা ছিল অস্ট্রিক সংস্কৃতির দেশ। পুরাণে চণ্ডী ও দুর্গা অভিন্ন।
ইতিহাসের পায়ে পায়ে যত দিন গড়িয়েছে বদলাতে শুরু করেছে রাইপুর। দিন বদলালেও বিস্মৃতির অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়নি রাজা মহারাজাদের কাহিনী। খাতড়া রাইপুর রাস্তার পাশে হরিহরগঞ্জ গড়ে এখনও রয়েছে রাজবাড়ি, জগন্নাথ ও হনুমানজীর মন্দির। সেই বাড়িতেই বর্তমানে থাকেন রাজা হরিহর সিংহদেবের বর্তমান বংশধরেরা। রাজ পরিবারের বংশধর মধুসূদন সিংহদেব, গোপীনাথ সিংহদেব বলেন, “সরকারিভাবে উদ্যোগ নিলেই আগেকার রাজাদের স্মৃতি অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে। নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে রাজাদের ইতিকথা। দেরিতে হলেও রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতি মন্দির ও রাজবাড়ির সংস্কার করেছে।” রাইপুরের বিডিও দীপঙ্কর দাস বলেন, “রাইপুরে রাজপরিবারের মন্দির সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। রাজবাড়ির ঐতিহ্য ও স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্যই এ গুলির রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।”
স্বাধীনতা লড়াইয়েও রাইপুর অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। জানব সে কাহিনিও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy