Advertisement
E-Paper

চোলরা কি এসেছিল, জনশ্রুতি চেলিয়ামায়

দামোদরের দক্ষিণ প্রান্তের চেলিয়ামাও নিজস্ব স্বকীয়তা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই শহর যে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন তার প্রমাণ রাধাবিনোদের মন্দির। টেরাকোটার অপূর্ব কাজে সমৃদ্ধ এই মন্দিরে লেখা লিপিতেই স্পষ্ট মন্দিরটি তিন শতাব্দীরও প্রাচীন। লোক গবেষকদের মতে, লিপিটিকে বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি তৈরি হয়।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০২
প্রাচীন রাধাবিনোদ মন্দির।  নিজস্ব চিত্র

প্রাচীন রাধাবিনোদ মন্দির। নিজস্ব চিত্র

দামোদরের দক্ষিণ প্রান্তের চেলিয়ামাও নিজস্ব স্বকীয়তা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এই শহর যে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন তার প্রমাণ রাধাবিনোদের মন্দির। টেরাকোটার অপূর্ব কাজে সমৃদ্ধ এই মন্দিরে লেখা লিপিতেই স্পষ্ট মন্দিরটি তিন শতাব্দীরও প্রাচীন। লোক গবেষকদের মতে, লিপিটিকে বিশ্লেষণ করে জানা যায়, ১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটি তৈরি হয়।

এলাকায় এও কথিত রয়েছে, মৌর্য সম্রাট অশোক তাঁর দুই সন্তান মহেন্দ্র ও সিঙ্ঘমিত্রর নেতৃত্বে শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারে একদল ধর্ম প্রচারক পাঠিয়েছিলেন। সেই দলটি মগধ থেকে রাজগীর, ঝরিয়া, দামোদর নদ পেরিয়ে চেলিয়ামার উপর দিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। সেই সময় এখানে একটি মাঠে তাঁরা শিবির ফেলেছিলেন। এখন যে এলাকা কটকট্যাঁড় নামে পরিচিত। কারণ ওড়িয়া ভাষায় ‘কটক’ কথার অর্থ, সেনা ছাউনি। আবার ‘চেলিয়ামা’ নামের উত্‌পত্তি নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। সম্প্রতি ‘চেলিয়ামার ইতিহাস ও কৃষ্টি’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছে ব্লক প্রশাসন। তাতে মূলত এই ব্লকের ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব ও সংস্কৃতি নিয়ে এলাকার লোক গবেষকরা আলোচনা করেছেন। সেই বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ ভারতের রাজবংশ চোল বা চেলরা সম্ভবত এই গ্রামটির স্থাপনা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে দাবি করা হয়েছে, ১০১২ খ্রিস্টাব্দে রাজেন্দ্র চোল বাংলা দখল করার পরে এই গ্রামটি স্থাপন করা হয়। কারণ রাজেন্দ্র চোল পাল বংশকে হারিয়ে বাংলার দখল নেন। এবং পাল বংশের রাজাদের সময়ে তৈলকম্পের রাজা রুদ্রশেখরের সময়কালে এই অঞ্চলে পাল বংশের আধিপত্য ছিল। ফলে জেলার ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের অনুমান, রাজেন্দ্র চোল এই এলাকাতেও পাল বংশের আধিপত্য খর্ব করে নিজের আধিপত্য স্থাপন করে গ্রামটির পত্তন করেন। সম্ভবত এই গ্রামটির আদি নাম ছিল চেলিয়াম্মা পরে অপভ্রংশ হয়ে তা চেলিয়ামাতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা তথা লোক গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “চোল বা চেল বংশের দ্বারা চেলিয়ামার পত্তন হয়েছিল, এই সম্ভবনাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ প্রথমত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সময় একটা বিষয় যার সাথে চোল বংশের এই এলাকায় আধিপত্য স্থাপনের ঘটনা যুক্ত রয়েছে। পাশপাশি চেলিয়ামা গ্রামের আদি দেবী মহামায়ার বহু পুরানো ভগ্ন মন্দির রয়েছে। এই মহামায়া বা মহায়াম্মা চোলদের উপাস্যদেবী ছিলেন।”

তবে নামকরণের বিতর্ককে পাশে সরিয়ে রেখে বলাই যায়, চেলিয়ামা গ্রামের রাধাবিনোদের মন্দির, পাশের বান্দা গ্রামের রেখ দেউল, মৌতোড় গ্রামের কালী সব মিলিয়ে ঐতিহ্য ও লোকগাথাতে পরিপূর্ণ চেলিয়ামা। রাধাবিনোদের মন্দির কে তৈরি করেছিলেন, সে বিষয়ে বিশদে জানাতে পারেননি মন্দিরের সেবাইত দীপক গোস্বামী। তবে মন্দিরের গায়ে লেখা লিপিতে উল্লেখ রয়েছে, সন্তোষ নামের এক ব্যক্তি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। তার বেশি কিছু জানা যায়নি। টেরাকোটায় মন্দিরের দেওয়ালের কারুকার্য আজও নজর কাড়ে। দেওয়ালে কৃষ্ণের গোপীদের বস্ত্রহরণ, রাম-রাবণের যুদ্ধ এবং শুম্ভ-নিশুম্ভের সাথে দেবী চণ্ডীর যুদ্ধ এই তিনটি পৌরাণিক কাহিনীর ছবি দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।

বান্দা গ্রামের পাথরের তৈরি দেউলটি পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সংরক্ষণের আওতায় এসেছে। এই মন্দিরের পাশেই একটি ইটের ভগ্নস্তূপ রয়েছে, যা গোঁসাই দেউল নামে পরিচিত। লোক গবেষকরা জানাচ্ছেন, এই এলাকায় প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। পরবর্তীকালে বাড়ি তৈরি করতে গিয়ে মাটির তলা থেকে পুরনো আমলের মুদ্রা, মাটির ভাঙা পাত্রও মিলেছে। বান্দার অদূরে মৌতোড় গ্রামের কয়েক শতাব্দী প্রাচীন কালী মন্দির নিয়েও কম জনশ্রুতি নেই। আবার চেলিয়ামা শহরের মধ্যে মহামায়া মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাবীর, ঋষভনাথের ভগ্ন জৈন মূর্তি। যেন সর্বধর্মের সমন্বয়ের আধার ছোট ভারত এই চেলিয়ামা।

কাজেই এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সাথে এলাকার সৌন্দর্যের মিশেলে পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। বাসিন্দাদের আক্ষেপ, চেলিয়ামা ও তেলকুপির উন্নয়নে প্রশাসন নজর দিলে ইতিহাস বাঁচত, পর্যটনেরও বিকাশ হতো। কিন্তু তা এখনও হয়নি। তবে বিডিও (রঘুনাথপুর ২) উত্‌পল ঘোষ এ নিয়ে আগ্রহী। তিনি বলেন, “প্রায় দেড় কোটি টাকার পরিকল্পনা রাজ্য পর্যটন দফতরে পাঠিয়েছি। আমরা তেলকুপিতে মূর্তিগুলির সংরক্ষণ করা, নদীর চড়ায় পার্ক থেকে নৌবিহারের ব্যবস্থা করতে চাই। সেই সঙ্গে চেলিয়ামা থেকে তেলকুপি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারেরও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।” তিনি জানান, ইতিমধ্যে তাঁরা চেলিয়ামায় পঞ্চায়েত সমিতির একটি অতিথিশালা চালু করেছেন। সেখানে থেকে এলাকার ইতিহাসের সঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও পর্যটকেরা মন ভরে উপভোগ করতে পারবেন।

amar shohor cheliyama shubraprakash mondal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy