নওয়াডিহি গ্রামের চার হাতের দুর্গা প্রতিমা। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
মা এখানে দশভুজা নন, চতুর্ভুজা। সেই সঙ্গে প্রতিমার মুখ থাকে পশ্চিম দিকে। আবার বেদিতে তোলার পরেই বেঁধে রাখা হয় প্রতিমাকে!
বহু যুগ ধরে এই অভিনব দুর্গাপুজোর আয়োজন করে আসছে সিউড়ির নগরী পঞ্চায়েতের নওয়াডিহি গ্রামের মজুমদার পরিবার। গ্রামে শতাব্দী প্রাচীন ওই দুর্গাপুজোর পাশাপাশি আরও একটি দুর্গাপুজো হয় রায় পরিবারে। তবে সেটি পটে। প্রতিমা পুজো বলতেই গ্রামে এই একটিই হয়। সে ক্ষেত্রে মজুমদার পরিবারের পুজোয় কেন এমন এই রীতি, তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না কেউ-ই। তবে, পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে, মজুমদারেরা আদতে বর্ধমানের বাসিন্দা। দৌহিত্র সূত্রে এই পুজো পেয়েছিলেন। কোনও তন্ত্রসাধকের কাছ থেকে। ওই সন্ত্রসাধকই এই ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে পুজো করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বর্তমানে মজুমদার পরিবারের শরিক বলতে দুই ঘর। প্রয়াত কৃষ্ণগোপাল মজুমদার এবং গৌরগোপাল মজুমদারদের পরিবার। গ্রামে থাকেন একমাত্র গৌরগোপালবাবুর মেজছেলে হরিসাধনবাবু এবং তাঁর পরিবার। হরিসাধনবাবুর বাকি তিন ভাই এবং কৃষ্ণগোপালবাবুর একমাত্র ছেলে কার্তিক মজুমদারেরা সকলেই বাইরে থাকেন। তাঁরা গ্রামে ফেরেন পুজোর সময়ে। তাঁরা গ্রামে ফেরার আগে পর্যন্ত তাই পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব হরিসাধনবাবু ও তাঁর স্ত্রী তুলুদেবীর। তাঁরা এবং ফোনে কার্তিকবাবু ও হরিসাধনবাবুর ভাই দুর্গাচরণবাবু সঙ্গে ফোনে (শান্তিনিকেতনের শিক্ষাসত্রের শিক্ষক) বাড়ির পুজোর ইতিহাস তুলে ধরলেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, বহু বছর আগে বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিল নওয়াডিহি। গ্রামে তখন চারটি দুর্গাপুজো হত। কিন্তু কলেরা মহামারির আকার নেওয়ায় ক্রমে গ্রামের আয়তন ছোট হয়। তবু শতাব্দী প্রাচীন মজুমদার বাড়ির দুর্গাপুজো বন্ধ হয়নি। ১০৮ খুলির উপর স্থাপিত বেদী, তন্ত্রসাধকের দেখানো পথেই পুজো হয়ে আসছে। তবে, কেন প্রতিমা পশ্চিমমুখী বা চতুর্ভুজা সেটা তাঁরা জানেন না। যদিও তাঁরা বলেন, “একবার সন্ধিপুজোর সময় প্রতিমা বেদি থেকে পড়ে যাওয়ার পর থেকে বেঁধে রাখার যে রেওয়াজ চালু হয়েছিল, তা আজও জারি আছে।”
মঙ্গলবার ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল ছায়াঘেরা পরিবেশে মাটির জীর্ণ দুর্গা মন্দির। ঠিক পাশেই দুই শরিকের দু’টি মাটির তৈরি বাড়ি। মন্দিরে তৈরি হচ্ছে দুর্গা প্রতিমা। মজুমদার পরিবারের শতাব্দী প্রাচীন দুর্গা মন্দির প্রাঙ্গণে এসে আন্দাজ করা শক্ত, নিঝুম শান্ত এই জায়গাটাই দিন কয়েকের মধ্যে ভরে উঠবে আনন্দে। এ বারের পুজোর পরে দ্বাদশী থেকেই দুর্গার বেদি অক্ষুণ্ণ মন্দির সংস্কার করার পরিকল্পনা করেছে ওই পরিবার। পরিবারের সদস্যেরা জানাচ্ছেন, যে যেখানেই থাকুক, পুজোর সময় সকলেই তাঁদের পরিবার নিয়ে গ্রামে ফেরেন। এমনকী হরিসাধনবাবু ও কার্তিকবাবুদের মোট ন’ বোন এবং তাঁদের পরিবারও বাড়ির পুজো ছেড়ে কখনও অন্য কোথাও থাকেননি বলে ভাইদের দাবি। পুজোর দিনগুলোয় সবাই মিলে আনন্দ করার পাশাপাশি বসে গানের আসরও। কারণ পরিবারের অনেক সদস্যই গান-বাজনার সঙ্গে যুক্ত। দুর্গাচরণবাবু ও কর্তিকবাবুরা বলছেন, “আমাদের পেশাও সঙ্গীত চর্চাকে ঘিরেই।” অন্য দিকে, যোগাযোগ করা হলে মজুমদার পরিবারের মেয়ে মীরা সেন, কৃষ্ণা সেন, বনানী সরকার, শিবানী মজুমদাররা বললেন, “নানা গল্প গাঁথা রয়েছে ওই পুজো ঘিরে। তবে, কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা জানি না।” এ নিয়ে অবশ্য তাঁরা ভাবতেও রাজি নন। শুধু পুজোর ক’টা দিন সকলে মিলে নিখাদ আনন্দে কাটাতে চান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy