Advertisement
E-Paper

ধান কেনা কম কেন, শিবিরে শুধুই ধাঁধা

খোলা বাজারে ধানের যা দাম, সরকার দিচ্ছে তারও বেশি। তবু গত মরসুমে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাষিদের কাছ থেকে ধান পাওয়া যায়নি। ধাঁধা নয়, তবুও সরকারি ভাবে ধান কেনার এই বাস্তব ছবিই ধাঁধা হয়ে উঠল খাদ্যমন্ত্রীর ধান কেনার শিবিরে। মঙ্গলবার বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকায় সরকারি ধান কেনার শিবির উদ্বোধন করতে এসেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ধাঁধার সদুত্তর অবশ্য পাওয়া যায়নি।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৩৭
ঝাড়াইয়ে ব্যস্ত। সারেঙ্গার কুসুমটিকরি গ্রামে ধানের শিবিরে। (ডান দিকে), আদিবাসী মেয়েদের নাচে খুশি হয়ে খাদ্যমন্ত্রী তাঁদের হাতে তুলে দিলেন নগদ টাকা। মঙ্গলবার উমাকান্ত ধরের তোলা ছবি।

ঝাড়াইয়ে ব্যস্ত। সারেঙ্গার কুসুমটিকরি গ্রামে ধানের শিবিরে। (ডান দিকে), আদিবাসী মেয়েদের নাচে খুশি হয়ে খাদ্যমন্ত্রী তাঁদের হাতে তুলে দিলেন নগদ টাকা। মঙ্গলবার উমাকান্ত ধরের তোলা ছবি।

খোলা বাজারে ধানের যা দাম, সরকার দিচ্ছে তারও বেশি। তবু গত মরসুমে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাষিদের কাছ থেকে ধান পাওয়া যায়নি। ধাঁধা নয়, তবুও সরকারি ভাবে ধান কেনার এই বাস্তব ছবিই ধাঁধা হয়ে উঠল খাদ্যমন্ত্রীর ধান কেনার শিবিরে।

মঙ্গলবার বাঁকুড়ার বিভিন্ন এলাকায় সরকারি ধান কেনার শিবির উদ্বোধন করতে এসেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। ধাঁধার সদুত্তর অবশ্য পাওয়া যায়নি। দিনের শেষে ভরসা একটাই, আধিকারিকদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রীর ঘোষণা— “আরও বেশি করে শিবির করতে হবে।”

অভাবি বিক্রি রুখতে ফি বছর জেলায় এসে সরকারি ভাবে ধান কেনার শিবিরের সূচনা করে যাচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী। কিন্তু বাঁকুড়া জেলা খাদ্য দফতর জানাচ্ছে, গত মরসুমে জেলায় প্রায় দেড় লক্ষ টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল সরকার। সেখানে মেরেকেটে প্রায় ১ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কেনা গিয়েছে। কম ধান কেনায় টান পড়েছে লেভি সংগ্রহের কাজেও। গত মরসুমে ৮০ হাজার টন লেভি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল এই জেলায়। সেখানে মোটে ৩৮ হাজার টন লেভি সংগ্রহ হয়েছে। অথচ চাষিরা জানাচ্ছেন, সরকারি শিবিরে ধান কেনার কথা ঘোষণা করা হলেও কবে, কোথায় ধান কেনা হবে তা জানানো হয়নি। তাই ফঁড়েদের কাছেই তাঁরা কম দামে ধান বিক্রি করেছেন। এ বার শিবিরগুলি ঘুরে এই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, ধান বিক্রিতে চাষিরা ইচ্ছুক থাকলেও সরকারি ভাবে ধান কেনার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলির সে সদিচ্ছা নেই। বাঁকুড়ার জেলা খাদ্য নিয়ামক শিবনারায়ণ পানিও স্বীকার করেছেন, “গত বছর একটি সংস্থা সে ভাবে ধান কেনার শিবির করেনি। তা ছাড়া ধান রাখার ক্ষমতাও এই জেলায় কম ছিল।” তবে এ বার তাঁর আশ্বাস, জেলায় ধান রাখার জন্য দু’টি গুদামঘর তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে ২২ হাজার মেট্রিক টন ধান রাখা যাবে। কিন্তু ধান কেনার সদিচ্ছা আসবে কী ভাবে? সদুত্তর নেই।

বস্তুত এ দিনের শিবিরগুলি ঘুরেও ধান বিক্রির বহরও তেমন নজরে আসেনি। তা খোদ দেখে গিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রীও। চলতি মরসুমে ধানের সরকারি মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ১৩৬০ টাকা। কিন্তু তালড্যাংরা, সিমলাপাল ও সারেঙ্গা ব্লকের কুসুমটিকরিতে মন্ত্রীর উদ্বোধন করা ধান কেনার শিবিরে দেখা গেল, খুব কম সংখ্যক চাষি ধান বিক্রি করতে এসেছেন। এ নিয়ে ক্ষোভ লুকিয়ে রাখতে পারেননি মন্ত্রীর সফর সঙ্গী শালতোড়ার বিধায়ক স্বপন বাউরি। সিমলাপালের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বলেই ফেলেন, “একজন মন্ত্রী কলকাতা থেকে ধান কেনার শিবিরের উদ্বোধন করতে এসেছেন, কিন্তু চাষিদেরই চোখে পড়ছে না! বেশি করে শিবিরের কথা প্রচার হওয়ার দরকার ছিল।”

তালড্যাংরা সমবায় সমিতির ম্যানেজার সরজকুমার রায় দাবি করেন, “প্রথা অনুযায়ী ইতু সংক্রান্তির (অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিন) দিনে জেলার চাষিরা ধান বিক্রি করতে চান না। ঘটনা চক্রে এ দিনই মন্ত্রী জেলায় এসেছেন। তাই চাষিদের উপস্থিতি একটু কম।” যদিও তবে তালড্যাংরার চাষিরা অবশ্য অন্য কথা বলছেন। মন্ত্রী আসছেন খবর পেয়ে শিবির দেখতে এসেছিলেন তালড্যাংরার ক্ষীরাইশোল গ্রামের চাষি অনিল লোহার, তাঁতিডাঙা গ্রামের চাষি অশ্বিনী ঘুলেরা। তাঁদের অভিযোগ, “কখন এই সমবায় সমিতি ধান কেনার শিবির করে আমরা জানতেই পারি না। ধান বিক্রির জন্য সমবায়ে যোগাযোগ করা হলে আমাদের চালকলে গিয়ে ধান বিক্রি করতে বলা হয়। সে অনেক হ্যাপা বলে ফঁড়েদের কাছেই কম টাকায় ধান বিক্রি করি। এই শিবিরের কথাও জানতে পারিনি।”

একই অভিযোগ উঠে এল সিমলাপাল ও কুসুমটিকরিতেও। সিমলাপাল ব্লকের মণ্ডলগ্রামের চাষি ভীমসেন রানা এ দিন ব্লক সদরে ডাক্তার দেখাতে এসে এই শিবিরের খবর পান। শিবিরে এসে তাঁর মাথায় হাত। তিনি বলেন, “সরকারি শিবির না হওয়ায় আমরা ক্যুইন্টাল পিছু ১১৫০ টাকায় ফঁড়েদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আগে খবর পেলে তাহলে নিশ্চয় সঙ্গে করে ধান নিয়ে আসতাম।” সিমলাপালের শিবিরে এ দিন ১০ ক্যুইন্টাল ধান বিক্রি করেছেন দেবকুমার সিংহবাবু। তাঁর আক্ষেপ, “আজই সকালে শিবিরের খবর দেওয়া হল। তাই বেশি ধান আনতে পারিনি। আগে খবর পেলে আরও ধান নিয়ে আসতাম। সরকারি শিবিরে ধান বিক্রি করার সুযোগ তো খুব একটা আসে না।” কুসুমটিকরির শিবিরে যাঁরা ধান বিক্রি করে মন্ত্রীর কাছ থেকে চেক নিয়েছেন, তাঁদের কেউ কেউ চাষি নয়, ব্যবসায়ী বলে অভিযোগ তুলেছেন কিছু চাষি।

মন্ত্রী অবশ্য প্রতিবারের মতোই এ বারও ধান বিক্রি করতে আসা চাষিদের কোনও ভাবেই ফেরানো চলবে না বলে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এ বার এমনটা ঘটলে চাষিদের তিনি অভিযোগ জানাতে দু’টি টোল ফ্রি নম্বর (১৯৬৭ ও ১৮০০৩৪৫৫৫০৫) এবং নিজের মোবাইল নম্বর বিলিয়ে গিয়েছেন। এ ছাড়াও অভাবি বিক্রি রুখতে ব্লকে পরিদর্শক নিয়োগ করা হবে বলেও তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, “ফোন পেলেই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমি ধান নিয়ে আসার ব্যবস্থা করব।” চাষিদের প্রতিক্রিয়া, “এতদিন আধিকারিকদের জানিয়ে লাভ হয়নি। ধান বিক্রি না হলে এ বার মন্ত্রীকেই জানাব। দেখি কী হয়!

ধান বিক্রি নিয়ে চাষিদের সন্তুষ্টি আদায় হল কি না জানা নেই। তবে অনুষ্ঠানে আসা নৃত্যশিল্পীরা খুশি হয়েছেন। কুসুমটিকরিতে আদিবাসী মহিলাদের নাচ দেখে অভিভূত খাদ্যমন্ত্রী শিবিরের মঞ্চে তাঁদের ডেকে নিজের পকেট থেকে কয়েক হাজার টাকা তুলে দেন। পরে মন্ত্রী বলেন, “ওঁরা ভালো নেচেছেন। জানলে শাড়ি কিনে আনতাম। তাই নিজের বেতনের টাকা থেকে কিছু দিয়েছি। এ নিয়ে কারও কিছু বলার নেই।”

rice camp jyotipriya mallick sarenga rajdip bandyopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy