বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনের কথা বলেন দার্শনিকরা। বীরভূম জেলার তৃণমূল নেতৃত্বও সেই পথে হাঁটছেন এখন। ২০১৩-র নলহাটি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফল এ বার বীরভূম জেলার ভোটচিত্রের আগাম সঙ্কেত হতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা।
রাজ্যে পরিবর্তনের দু’বছর পরে উপনির্বাচন হয়ছিল নলহাটিতে। ওই কেন্দ্রের বিধায়ক রাষ্ট্রপতি-পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বাবার ছেড়ে যাওয়া জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে দাঁড়ান। ফাঁকা হয়ে যাওয়া নলহাটিতেও তাই উপনির্বাচন হয়। কংগ্রেস ও তৃণমূলের সম্পর্ক তখন ছিন্ন। দুই দলের ভোট কাটাকুটিতে লাভবান হয় বামফ্রন্ট। ৫৫ হাজার ভোট পেয়ে জয়ী হন বাম প্রার্থী।
সরকারি ক্ষমতায় থেকেও নলহাটির উপনির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ৪৭ হাজার ভোট। আর তৃণমূলের সঙ্গ ছেড়েও কংগ্রেস পায় সাড়ে ৪৭ হাজার। যোগ করলে দাঁড়ায় প্রায় ৯৫ হাজার। অন্য দিকে বিজেপির ঝুলিতে পড়েছিল ১২ হাজার ভোট।
জেলা সিপিএম নেতৃত্বও এ কথা ভালই জানেন যে, নলহাটিতে তাঁরা নিজেদের সংগঠনের জোরে জেতেননি। জেলায় তখন বামফ্রন্টের সাংগঠনিক ক্ষমতা যে ভাল ছিল, তা মনে করেন না খোদ সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ও। জেলার আর এক সিপিএমের নেতার কথায়, “দল বিধ্বস্ত হলেও নিজেদের যেটুকু রিজার্ভ ভোট ধরে রাখতে পেরেছিলাম, তাতে ভোট ভাগাভাগির খেলায় আমাদের সুবিধা করে দিয়েছে।” এ বারও সংগঠন দুরন্ত অবস্থায় না থাকলেও ভাগাভাগির খেলায় শিকে ছিঁড়বে বলে আশাবাদী দিলীপবাবু। তৃণমূলের এক বিধায়কও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “বামেদের এই দুর্দিনেও গত পঞ্চায়েত ভোটে রামপুরহাট সদরের চারটি বিধানসভা কেন্দ্র, মুরারই, নলহাটি, হাসন ও রামপুরহাটের ফলাফলে দেখা গিয়েছে বামফ্রন্ট আমাদের থেকে সাড়ে ৩৮ হাজার ভোটে এগিয়ে রয়েছে।”
কংগ্রেস ও তৃণমূলের ভোট ভাগাভাগির এই সম্ভাবনা এ বারও পুরোমাত্রায় বর্তমান। তৃণমূলের চিন্তা বাড়াচ্ছে আরও দু’টো ঘটনা। প্রথমটা অবশ্যই মোদী-হাওয়া। যার জেরে বিজেপির ভোট ভাল রকম বাড়বে। অর্থাৎ তৃণমূল আর কংগ্রেস নয়, বিজেপিও ভোট ভাগাভাগিতে একটা বড় ভূমিকা নেবে। এবং মোদীর হাওয়া তৃণমূলের ঘর বেশি ভাঙবে বলে আশঙ্কা দলেরই একাংশের।
গত এক বছরে সারদা কেলেঙ্কারি এবং প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ (টেট) নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ে উঠেছে ভোটারদের একাংশের মনে। সঙ্গে রয়েছে বীরভূম জেলার নিজস্ব পাড়ুইয়ের ঘটনা এবং অনুব্রত-মনিরুল ফ্যাক্টর। সিউড়িতে সিপিএম সমর্থক হীরালাল শেখকে নৃশংস ভাবে পিটিয়ে খুন করার ঘটনাও শাসক দলকে বিব্রত করেছে। এই সবই এই জেলায় দলকে বেগ দিতে পারে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। সুতরাং তৃণমূলের ভোট কমা, বিজেপির ভোট বাড়া এবং কংগ্রেসের ভোট আলাদা থেকে যাওয়া এই ত্র্যহস্পর্শ ফের বামেদের সুবিধা করে দিতে পারে বলে আশঙ্কা।
কপালে তাই ভাঁজ জেলা তৃণমূলের একাংশের। দলের অন্য অংশ এই তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। তাঁদের বক্তব্য, জেলায় কংগ্রেস এমনিই দুর্বল। বামেদের শক্তিও ক্ষীণ। আর মোদী-ফ্যাক্টর বামেদের ভোটে ভাগ বসাবে না, এমন ভাবারও কারণ নেই। রামপুরহাটের পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারির যেমন বক্তব্য, “বিজেপি যদি কিছু ভোট কাটেও, তা সামলানোর ক্ষমতা তৃণমূলেরই আছে। বাকিদের নেই।” রামপুরহাটের বিধায়ক তৃণমূলের আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, “বামেরা কোণঠাসা। বিজেপি ও কংগ্রেসের তেমন সংগঠন নেই। জেলার অনেক কেন্দ্রে বিরোধীরা এজেন্টই দিতে পারবে না।”
আশিসবাবুর এই কথাটা প্রচ্ছন্ন হুমকি বলেই মনে করছেন বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য, “বিজেপির জনপ্রিয়তা দেখে ওঁরা ত্রস্ত। তাই অত্যন্ত সচেতন ভাবেই ভয় দেখানোর রাজনীতি করেছেন।” একই অভিযোগ সিপিএমেরও। জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও ইঙ্গিত দেন, সাবেক সিপিএমের কায়দাতেই ভোট করতে চান তাঁরা। তাই অনুব্রতর হাত ধরে ফের ‘সন্ত্রাস’ হতে পারে বলে আগাম অভিযোগ শোনাচ্ছেন বোলপুরের সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। তবে সব পক্ষই একটা কথা মানছেন, এ বারে শক্ত লড়াই।
এখন ভাগাভাগির কোন তত্ত্বটি বাস্তবে খাটবে, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy