Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

মুক্ত দীপ, উৎসবের মেজাজে ইন্দাস

দিবাকরবাটির ওই বাড়িতে আজ শুধুই স্বস্তি। দমবন্ধ করা চারটে মাস কাটানোর পরে বাড়িটাতে আজ যেন মুক্তির আনন্দ। সবাই প্রাণ খুলে হাসছে। মন খুলে কথা বলছে। কারণ, মিজোরাম থেকে জঙ্গিদের হাতে অপহৃত হওয়ার পরে টানা চার মাস বন্দি থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন বাড়ির ছেলে দীপ মণ্ডল।

উচ্ছ্বাস। দীপের পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাসিন্দারা (বাঁ দিক থেকে দীপের বাবা, বোন ও মা)—নিজস্ব চিত্র।

উচ্ছ্বাস। দীপের পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাসিন্দারা (বাঁ দিক থেকে দীপের বাবা, বোন ও মা)—নিজস্ব চিত্র।

দেবব্রত দাস
ইন্দাস শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৪ ০১:১১
Share: Save:

দিবাকরবাটির ওই বাড়িতে আজ শুধুই স্বস্তি। দমবন্ধ করা চারটে মাস কাটানোর পরে বাড়িটাতে আজ যেন মুক্তির আনন্দ। সবাই প্রাণ খুলে হাসছে। মন খুলে কথা বলছে।

কারণ, মিজোরাম থেকে জঙ্গিদের হাতে অপহৃত হওয়ার পরে টানা চার মাস বন্দি থেকে অবশেষে মুক্তি পেয়েছেন বাড়ির ছেলে দীপ মণ্ডল। তাঁর পরিবার তো বটেই, আজ খুশি গোটা দিবাকরবাটি গ্রাম। খুশি গোটা ইন্দাস। দিন দুয়েক আগে থেকেই জঙ্গিরা দীপকে মুক্তি দিতে পারে বলে খবর পেয়েছিলেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। শনিবার রাতে দীপ নিজেই বাবাকে ফোন করে তাঁর মুক্তি পাওয়ার খবর জানিয়েছেন। সেই ফোন পেয়েই আত্মহারা হয়ে পড়েছে দীপের গোটা পরিবার। দীপের পরিবার সূত্রের খবর, মুক্তিপণের বদলেই তাঁকে ছেড়েছে জঙ্গিরা।

রবিবার সকাল থেকেই কার্যত উৎসবের চেহারা নেয় দিবাকরবাটি। এ দিন সকাল থেকেই দীপের বাড়িতে ভিড় জমাতে শুরু করেন তাঁর বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, পাড়া-পড়শি থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। দীপ এখন কত দূরে, কবে গ্রামে ফিরবেন, এমন নানা প্রশ্নই সারাদিন ধরে চর্চা হয়েছে দিবাকরবাটির মণ্ডলবাড়িতে। আবির খেলা থেকে শুরু করে মিষ্টিমুখ, সবই হয়েছে দীপের মুক্তির আনন্দে। তবে, ঘরের ছেলে জঙ্গি-কবল থেকে মুক্তির খবরে উচ্ছ্বাসের থেকেও বেশি ছিল স্বস্তি। এত দিন প্রতিটা মুহূর্ত চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটানো এই বাড়ির সকলের চোখেমুখেই ছিল স্বস্তির ছাপ।

গত বছর দুর্গাপুজোর আগে দিল্লির একটি বেসরকারি টেলিকম নেটওয়ার্ক সংস্থার কলকাতার অফিসে যোগ দেন বছর চব্বিশের দীপ। পুজোর সময় বাড়িতে এসেছিলেন। পরে তাঁকে গুয়াহাটিতে বদলি করা হয়। ভাইফোঁটার দিন গত ৫ নভেম্বর দুপুরে বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে গুয়াহাটিতে চলে যান তিনি। সেখান থেকে গত ২০ নভেম্বর মিজোরামের মামিট জেলায় যান। ২৩ নভেম্বর মামিট জেলার ডাম্পা ব্যাঘ্র প্রকল্পের চিখা বন শিবিরের কাছে তুইপুইবাড়ির জঙ্গলে একটি মোবাইল টাওয়ার বসানোর কাজ করতে গিয়েছিলেন দীপ। ওই দিনই ডাম্পারেংপুই ও রাজীবনগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে দীপ, তাঁর ভাড়া গাড়ির চালক সাংলিয়ান থাঙ্গা এবং অন্য একটি পিক-আপ ভ্যানের চালক লাল জামলিয়ানকে ‘ব্রু’ বা রিয়াং জঙ্গিরা অপহরণ করেছিল।

পুলিশ সূত্রের খবর, এর পরে অপহৃতদের নিয়ে জঙ্গিরা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে যায়। তাঁদের মুক্তির দাবিতে মিজোরামে আন্দোলন শুরু হলে জঙ্গিরা গত ২০ জানুয়ারি অপহৃত দুই গাড়ি-চালককে মুক্তি দেয়। কিন্তু, দীপকে না ছেড়ে জঙ্গিরা কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তাঁর সংস্থা এবং পরিবারের কাছে। এ দিকে, দীপের মুক্তির দাবিতে ইন্দাসের মানুষ প্রতিবাদে সরব হন। মিছিল, বিক্ষোভ থেকে রাস্তা অবরোধ বা বন্ধ সবই হয়েছে ইন্দাসে। দীপের মুক্তিপণ নিয়ে জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর সংস্থার দরাদরি যত বেড়েছে, ততই দিবাকরবাটির মণ্ডল পরিবারের উৎকণ্ঠা বেড়েছে। এত দিন কার্যত নাওয়া-খাওয়া ভুলতে বসছিলেন দীপের বাবা, মা ও একমাত্র বোন।

ইন্দাসের দিবাকরবাটিতে অ্যাস্বেস্টসের ছাউনি দেওয়া ইটের এক তলা বাড়ি ও বিঘে দুয়েক জমিই সম্বল দীপের বাবা নিখিল মণ্ডলের। চাষাবাদের পাশাপাশি বাড়ির পাশে একটি প্যাথলজি ল্যাবে কাজ করে সংসার চালান তিনি। দীপের পিসতুতো দাদা অর্ণব মণ্ডল শনিবারই মিজোরামের রাজধানী আইজলে পৌঁছন। রবিবার আইজল থেকে অর্ণব ফোনে বলেন, “দীপকে জঙ্গিরা মুক্তি দিয়েছে। সোমবারের মধ্যেই ওকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে যেতে পারব বলে আমি আশাবাদী।” নিখিলবাবু এ দিন বলেন, “শনিবার রাত পৌনে ১০টা নাগাদ দীপ আমাকে ফোন করে বলেছিল, ‘ওরা (জঙ্গিরা) আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমি অফিসারদের সঙ্গে এখন জঙ্গলপথে হাঁটছি। ফোনে টাওয়ারের সমস্যা হচ্ছে।’ রবিবার তোমাকে ফোন করব’।”

“জঙ্গিরা কী ভাবে ওকে অপহরণ করেছিল, কোথায় রেখেছিল, দাদা ফিরে এলে সব জানতে চাইব”বলছিলেন দীপের বোন মধুমন্তী। নিখিলবাবু জানান, দীপকে ছাড়ার ব্যাপারে জঙ্গিরা নানা টালবাহনা করছিল বলে তাঁরা উদ্বেগে ছিলেন। এখন দীপ বাড়ি ফিরে এলে তাঁরা নিশ্চিন্ত। দীপের মা অঞ্জনা মণ্ডলের কথায়, “যাক এত দিন পরে দীপকে মুক্তি দিল ওরা। কত দিন ওকে দেখেনি। কখন ও বাড়ি ফিরবে, সেই আশায় পথ চেয়ে বসে রয়েছি।” অপেক্ষায় ইন্দাসের বাসিন্দারাও। দীপের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে সামিল হওয়া তাঁর বন্ধু মানস রায়, বিশ্বরূপ ভট্টাচার্য, ইন্দাস হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক পাঁচুগোপাল আদিত্যরা বললেন, “ওর মুক্তির আনন্দে আমরা মিষ্টিমুখ করিয়েছি। আবির খেলেছি। দেরিতে হলেও দীপের মুক্তির দাবিতে আমাদের আন্দোলন এত দিনে সার্থক হল বলে মনে হচ্ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

indas deep mondal mizo terrorists
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE