Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

স্বচ্ছ জেলা দূর অস্ত্‌, মানুষ ছুটছে মাঠেই

তিন বছরে ‘স্বচ্ছ’ জেলা গড়তে নেমে গোড়াতেই খোঁড়াতে শুরু করেছে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। জেলার ঘরে ঘরে শৌচালয় গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও গত ১০ মাসে কাজের যা অগ্রগতি, তাতে সময়সীমার মধ্যে আদৌ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো যাবে কি না তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে জেলা প্রশাসনের অন্দরেই। কাজের গতি বাড়াতে নিয়মিত জেলায় এসে আধিকারিকদের সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ করছেন খোদ একশো দিনের প্রকল্পের রাজ্য কমিশনার।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:০৩
Share: Save:

তিন বছরে ‘স্বচ্ছ’ জেলা গড়তে নেমে গোড়াতেই খোঁড়াতে শুরু করেছে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। জেলার ঘরে ঘরে শৌচালয় গড়ার পরিকল্পনা নেওয়া হলেও গত ১০ মাসে কাজের যা অগ্রগতি, তাতে সময়সীমার মধ্যে আদৌ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনো যাবে কি না তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে জেলা প্রশাসনের অন্দরেই। কাজের গতি বাড়াতে নিয়মিত জেলায় এসে আধিকারিকদের সঙ্গে হাতে-কলমে কাজ করছেন খোদ একশো দিনের প্রকল্পের রাজ্য কমিশনার। কিন্তু তাতেও কাজ এগোচ্ছে না।

কোথায় আটকে যাচ্ছে এই প্রকল্পের গতি? জানতে চাওয়া হলে ‘জল না মেপেই পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার’ তত্ত্ব উঠে আসছে জেলা প্রশাসনিক আধিকারিকদের কাছ থেকে। তিন বছরে প্রায় ৪ লক্ষ ৭৬ হাজার পরিবারে শৌচালয় গড়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে প্রশাসন। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে গেলে বছরে দেড় লক্ষের বেশি শৌচালয় গড়তে হবে। কিন্তু গত এপ্রিল মাস থেকে শুরু করে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মোটে ২৩,২০৬টি শৌচালয় তৈরি করা গিয়েছে। ফলে কী ভাবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। তা নিয়ে সন্দিহান প্রশাসনের আধিকারিকরাই। এ দিকে ২০১৭ সালের মধ্যে রাজ্যকে ‘নির্মল’ দেখার ইচ্ছের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ধাপে ধাপে এই ক্ষেত্রে সরকারি অনুদানের পরিমাণ বেড়েছে। কিন্তু রাজ্য এখনও নির্মল হয়নি। এখন শৌচালয় গড়তে ১০ হাজার টাকা স্বচ্ছভারত মিশন গ্রামীন প্রকল্প দিচ্ছে। বাকি ৯০০ টাকা গ্রাহককে দিতে হচ্ছে। এ ছাড়াও প্রতিটি শৌচালয় পিছু ২ হাজার টাকা জলের সংযোগের জন্য দেওয়া হচ্ছে। শৌচালয় তৈরির দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (এনজিও) ও স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির। কিন্তু বাঁকুড়া জেলায় এই কাজের এনজিও-র অভাব রয়েছে। অন্য দিকে, আবার টাকা পয়সার অভাবে বহু স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীও এগিয়ে আসছে না এই প্রকল্পে। এক কথায় এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করার লোকের অভাব দেখা দিয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত এনজিও বাঁকুড়ার শময়িতা মঠের সম্পাদক ঋষিঋদ্ধা অনাহতা জানান, ১০ হাজার টাকায় শৌচালয় গড়তে ঠিকাদারেরা এগিয়ে আসবে না। তাই এলাকার যুবকদেরই এই কাজের দায়িত্ব দিচ্ছে এনজিওগুলি। অন্য দিকে, বেশির ভাগ স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর টাকা পয়সার অভাব রয়েছে। সরকারি প্রকল্পের নিয়মে আগে নিজেকে টাকা ঢেলে কাজ করে রাখতে হয়। কাজ শেষ হলে বকেয়া টাকা পাওয়া যায়। এই নিয়মের জেরে স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির পক্ষে কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিপুল পরিমাণ টাকা ঢালার সামর্থও নেই, জানাচ্ছে কিছু এনজিও-ও।

জেলা প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, হাতে গোনা প্রায় ১০টি এনজিও এই প্রকল্পে কাজ করছে। কিন্তু তা দিয়ে যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অনেক সময় লাগবে তা প্রশাসনিক কর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন। এ দিকে, প্রকল্পের আরও একটি প্রতিবন্ধক হল সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। খোলা আকাশের নীচে শৌচকর্ম করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া প্রত্যন্ত গ্রামের বহু পরিবারই এককালীন ৯০০ টাকা খরচ করে বদ্ধঘরে শৌচকর্ম করতে নারাজ। তাঁদের এই প্রকল্পে রাজি করাতে গিয়ে কাজ শুরু করার আগেই ব্যয় হয়ে যাচ্ছে বহু দিন। এতেও প্রকল্পের গতি কমছে বলে জানাচ্ছেন প্রশাসনিক কর্তারা।

এ দিকে ২০১৭ সালের মধ্যে নির্মল রাজ্য গড়ার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার জেরে ঘুম ছুটেছে জেলার প্রশাসনিক কর্তাদের। মাসখানেক আগে নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠকে এই প্রকল্পে জেলার হাল দেখে চটে গিয়ে জেলা সভাধিপতি ও জেলাশাসকের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রকল্পের গতি বাড়াতে এ বার তাই গ্রামপঞ্চায়েতগুলিকেই দায়িত্ব দেওয়ার চিন্তা ভাবনা করেছে জেলা প্রশাসন। এ ক্ষেত্রে গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে এই প্রকল্পে নিজেদের এলাকার স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, এনজিও ও যুবকদের দিয়ে শৌচালয় গড়ার কাজ শুরু করতে এবং মাইকে প্রকল্পের কথা প্রচারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আবার কিছু কিছু পঞ্চায়েত প্রধান অতীতে সরকারি প্রকল্পের বকেয়া টাকা আদায় করা নিয়ে নিজেদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। যেমন বড়জোড়া ব্লকের ছান্দার গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সদানন্দ মান ও ছাতনা ব্লকের শালডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান টেলু কর বলেন, “জেলা প্রশাসনের নির্দেশ পাওয়ার পরেই এলাকার এনজিও, স্বয়ম্ভরগোষ্ঠী ও স্থানীয় যুবকদের নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। কিন্তু সকলেই জানিয়েছে, নিজেদের টাকা ঢেলে তাঁদের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। তবে আমাদের অনুরোধে তাঁরা ঋণ নিয়ে কাজে নামতে শেষ পর্যন্ত রাজি হলেও দ্রুত বকেয়া টাকা মেটানোর শর্ত জুড়ে দিয়েছেন।” তাঁদের মতো অনেক প্রধানেরই আশঙ্কা, এ ভাবে রাজি করিয়ে কাজে নামানোর পরে জেলা প্রশাসন যদি বকেয়া টাকা মেটাতে দেরি করে তাহলে তাঁদেরই রোষের মুখে পড়তে হবে!

টেলুবাবু বলেন, “শৌচালয় গড়তে পঞ্চায়েতকে ওয়ার্ক অর্ডার দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু টাকা আসবে বিডিওর তহবিলে। এটাই ভয়ের। আমি বিডিওকে বলেছি কাজ হয়ে যাওয়ার পরে দ্রুত টাকা মেটাতে হবে।” টাকা মেটাতে সমস্যা হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন এই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) পার্থ ঘোষ। তাঁর মতে, “গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে শৌচালয় গড়ার নির্দেশ দেওয়ায় আশাকরি এ বার কাজের গতি বাড়বে। এই প্রকল্পে প্রচুর টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তাই বকেয়া টাকা মেটাতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।” জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী জানান, পঞ্চায়েতগুলিকে আরও আগে জড়ানো উচিত ছিল। জেলা পরিষদের বিরোধী দল নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামাঞ্চলের জনপ্রতিনিধি ও সরকারি আধিকারিকেরা যদি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেন, তাহলে এই প্রকল্পের গতি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।”

তবে শুধু শৌচালয় গড়াই যে এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য নয় তা জেলায় এসে বারবার আধিকারিকদের মনে করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন ১০০ দিনের প্রকল্পের রাজ্য কমিশনার দিব্যেন্দু সরকার। খোলা আকাশের নীচে শৌচকর্ম বন্ধ করতে ঘরে ঘরে শৌচালয় গড়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে। অনেকক্ষেত্রেই সরকারের গড়ে দেওয়া শৌচালয় ব্যবহার না করে বাসিন্দারা ফেলে রেখেছেন। জেলায় এ ক্ষেত্রে অন্যতম উদাহরণ বিষ্ণুপুর ব্লকের ছোট বাঁকাদহ গ্রাম। বছর সাতেক আগে এই গ্রামের বেশ কিছু পরিবারে ২০০ টাকার বিনিময়ে শৌচকর্মের সরঞ্জাম বসিয়েছিল প্রশাসন। উদ্দেশ্য ছিল খোলা মাঠে শৌচকর্ম করা আটকানো। সাত বছর পরে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, গ্রামের খোলা মাঠেই ছুটছেন বাসিন্দারা। শৌচকর্মের সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্রামবাসীর অভিযোগ, শুধু সরঞ্জাম বসিয়েই খালাস আধিকারিকেরা। লজ্জা নিবারণের জন্য চারপাশ ঘিরে দেয়নি। জেলায় এসে তাই দিব্যেন্দুবাবু আধিকারিকদের বলে গিয়েছেন, “ক’টা শৌচালয় গড়লেন তা গুনতে যাবেন না। বরং ক’টা মানুষকে খোলা মাঠ থেকে শৌচালয়মুখো করতে পারলেন সে দিকে নজর দিন। তবেই প্রকৃত অর্থে গ্রাম ‘নির্মল’ হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE