Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য, ক্ষুব্ধ বড়রা

বোমা ফাটাতে ফাটাতে ৭০-৮০ জনের দুষ্কৃতী দলটি হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। দুষ্কৃতীরা প্রথমে টিভি, ফ্রিজ, অলঙ্কার, নগদ টাকা-সহ নানা আসবাবপত্র লুঠ করে। তার পরে রীতিমতো পেট্রোল ঢেলে, বাড়ির রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার খুলে দিয়ে বাকি সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় উঠোনে থাকা একটি চার চাকা ও দু’টি মোটরবাইকও!

আগুনে ছাই তৃণমূল নেতার ভাইয়ের বাড়ি। ডান দিকে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাড়িও। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

আগুনে ছাই তৃণমূল নেতার ভাইয়ের বাড়ি। ডান দিকে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গাড়িও। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত

নিজস্ব সংবাদদাতা
কাঁকরতলা শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৭
Share: Save:

বোমা ফাটাতে ফাটাতে ৭০-৮০ জনের দুষ্কৃতী দলটি হুড়মুড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। দুষ্কৃতীরা প্রথমে টিভি, ফ্রিজ, অলঙ্কার, নগদ টাকা-সহ নানা আসবাবপত্র লুঠ করে। তার পরে রীতিমতো পেট্রোল ঢেলে, বাড়ির রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার খুলে দিয়ে বাকি সব কিছুতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় উঠোনে থাকা একটি চার চাকা ও দু’টি মোটরবাইকও!

শুক্রবার সকালে কাঁকরতলার বড়রা গ্রামে গিয়েই ওই তাণ্ডবের চিহ্ন দেখা গেল। যে ঘটনায় কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এলাকার তৃণমূল নেতা উজ্জ্বল হক কাদেরির দাদা শেখ কাজল ওরফে শেখ নাসের আলির বাড়ি। বৃহস্পতিবার রাতের যে ঘটনায় বোমার আঘাতে জখম হয়ে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্‌সাধীন কাজলের ছোট মেয়ে নওরিন মুস্তারেক। ওই হামলার ঘটনায় রাতেই পুলিশ শেখ এনাই ওরফে ডোমা নামে বড়রা গ্রামেরই এক বাসিন্দাকে গ্রেফতার করেছে। এ দিকে, গোটা ঘটনায় ফের সামনে চলে এসেছে খয়রাশোল ব্লকের তৃণমূলের প্রাক্তন দুই নেতা নিহত অশোক ঘোষ এবং অশোক মুখোপাধ্যায় গোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্বের কথা। তৃণমূল নেতারাও যা আড়াল করতে পারছেন না। রাতের ওই ঘটনায় যিনি মূল অভিযুক্ত, সেই শেখ জয়নাল তৃণমূলেরই খয়রাশোল পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত সদস্য। মাস কয়েক আগে বাড়ির কাছে খুন হয়ে যাওয়া দলের প্রাক্তন সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায় খুনে অভিযুক্ত যে নেতাকে বহুদিন ধরেই খুঁজছে। জয়নাল, শেখ মানা, শেখ খেলাফত, শেখ কালো-সহ যে ২৬ জনের বিরুদ্ধে কাঁকরতলা থানায় পরিবারটি অভিযোগ দায়ের করেছে, তাতেও ঘটনায় শাসক দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের ছায়া আরও স্পষ্ট হয়েছে।

অবশ্য ওই ঘটনায় পুলিশ দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিক বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “ঝাড়খণ্ডের কয়লা কারবার ও পঞ্চায়েতে দখল নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ। বৃহস্পতিবার রাতে কারা হামলা চালিয়েছে, পুলিশ তদন্ত করে দেখুক। দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিক। শেখ জয়নাল বা উজ্জ্বল হক কাদেরি, কেউ-ই এ ব্যাপারে দলের সমর্থন পাবে না।”

এ দিন সকালে বড়রায় গিয়ে কাজলের বাড়ির সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে যুক্ত টিনের দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকেই চোখে পড়ল পুড়ে যাওয়া চার চাকা ও মোটরবাইক দু’টি। বিরাট দোতলা বাড়ির মধ্যেও পোড়ার একই ছবি। চারদিক কালো হয়ে রয়েছে। আগুনের তীব্রতায় চাঙড় খসে পড়েছে। কাজলের স্ত্রী ইসমতারা বেগম বললেন, “গত রাতে ৭০ থেকে ৮০ জন লোক বন্দুক-বোমা নিয়ে হামলা চালায়। আমি তখন রুটি বানাচ্ছিলাম। ঘরের ভেতরে দুই মেয়ে নাজনিন ও নওরিন পড়াশোনা করছিল। ওদের বাবা ঘরেই ছিলেন। কী তাণ্ডবটাই না ওরা চালালো!” তাঁর অভিযোগ, “পেট্রোল ঢেলে, গ্যাস সিলিন্ডার খুলে বাড়িতে আগুন লাগানোর আগে টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল, গয়না, টাকা সব বয়ে নিয়ে গিয়েছে। আমরা ভয়ে চুপ করে একটা ঘরে সিঁটিয়ে ছিলাম। তখনই দুষ্কৃতীরা ওই ঘরের দরজায় বোমা মারে। বোমার আঘাতে ছোট মেয়ে ঘায়েল হয়। কোনও ক্রমে প্রাণ ভিক্ষা পেয়েছি।” তাঁর দাবি, দুষ্কৃতীরা তাঁর দেবরের (উজ্জ্বল) খোঁজ করছিল। বৃহস্পতিবার রাতে ফোনে অভিযুক্ত জয়নাল অবশ্য ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নই বলে দাবি করেছেন। যদিও এ দিনও কাজলের বোন কেনিজ রাশেদ (যিনি বড়রা পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যও) সে কথা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, “আক্রমণে সামিল ছিলেন জয়নালই। ওরা কী হিংস্র আক্রমণটাই না চালিয়েছে, তা একমাত্র আমরাই জানি। ওঁরা আমাদের পুড়িয়েই মারতে চেয়েছিল। কোনও রকমে সবাই বেঁচে গিয়েছে।”. কাজলের আবার দাবি, ভাই বা বোন দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তিনি সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করেন না।

পুলিশ ও তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, এই গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব যত না দলের মধ্যে নিজের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ করা নিয়ে, তার চেয়ে ঢের বেশি স্থানীয় বড়রা পঞ্চায়েত এবং এলাকার অবৈধ কয়লা সাম্রাজ্যের দখলদারি নিয়ে। পুলিশের দাবি, বড়রা পঞ্চায়েত এবং লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের নলা থানার কাস্তা (জোড়কুড়ি) অবৈধ কয়লা খাদানের দখলকে ঘিরে উজ্জ্বল হক কাদেরি এবং শেখ জয়নালের লোক জনের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ দিনের। একটা সময় অশান্তি মাত্রাতিরিক্ত জায়াগায় পৌঁছে গেলে পুলিশ দুই নেতাকেই গ্রেফতার করেছিল। প্রাক্তন ব্লক সভাপতি অশোক ঘোষ খুন হওয়ার পরে অশোক মুখোপাধ্যায়-সহ মুখোপাধ্যায় গোষ্ঠীর অনেকে ওই ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে এলাকাছাড়া হন। সেই সুযোগে এলাকার কর্তৃত্ব ফের ঘোষ অনুগামীদের হতে চলে গিয়েছিল। তখন শেখ জয়নালের কিছুটা সুবিধা হয়েছিল। আবার অশোক মুখোপাধ্যায় জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় আসার পরে ধীরে ধীরে নিজের হারানো মাটি পুলরুদ্ধারে সচেষ্ট হন তাঁর অনুগামী উজ্বল হক কাদেরি। কিন্তু খয়রাশোলের লোকপুর পুলিশ ফাঁড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় ফের অভিযুক্ত ও গ্রেফতার হয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়েন উজ্জ্বল হক কাদেরি। ওই সময় আবার স্বমহিমায় এলাকায় ছিলেন শেখ জয়নাল। পরিস্থিতি আবার ঘুরে যায় অশোক মুখোপাধ্যায়ের খুনের পরে অন্যতম অভিযুক্তের তালিকায় জয়নালের নাম থাকায়। ইতিমধ্যেই জামিন পেয়ে এলাকায় এসে ক্ষমতা দখল করেন উজ্বল। অন্য দিকে, এলাকাছাড়া জয়নালের কিছু লোক জনকেও তিনি নিজের দিকে ভিড়িয়ে নেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। ওই সময়ই একাধিকবার জয়নালের বাড়িতে বোমাবাজি করা হয়েছিল বলে অভিযোগ।

এ দিকে, চুটিয়ে চলছিল এলাকায় অবৈধ কয়লা কারবারের ব্যবসা। সমস্যা তৈরি হয় মাস খানেক আগে থেকে। পুলিশ সূত্রের খবর, উজ্জ্বল ও জয়নালের গোষ্ঠীর মধ্যে ওই গণ্ডগোলের জেরে এলাকায় উত্তেজনা শুরু হয়। বোমা ফেটে দু’দুবার জখম হওয়া-মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছিল। বেকায়দায় পড়েন উজ্জ্বল। ক্ষমতা বাড়ে জয়নালের। অশোক মুখোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ শেখ মানার সঙ্গেও তাঁর বোঝাপড়া হয় বলে খবর। নানা কারণে বেকায়পড়া উজ্জ্বলের দাদা কাজলের উপরেও ওই গোষ্ঠীর লোক জনের ক্ষোভ ছিল। এ সব কারণই বৃহস্পতিবার রাতে হামলার নেপথ্যে রয়েছে বলে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি।

তবে, গোটা বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখছেন না বড়রা গ্রামের মানুষ। নিত্য অশান্তি ও সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য দেখতে দেখতে পুলিশের ভূমিকায় তাঁরা চরম ক্ষুব্ধ। এলাকার সাধারণ মানুষ শান্তি চান। অশোক ঘোষ ও অশোক মুখোপাধ্যায় খুন হওয়ার অনেক আগে থেকেই লড়াই শুরু হয়েছে। ২০১২ সালের মে মাসে একই দিনে আধ ঘণ্টার ব্যবধানে মুখোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠ নেতা গোলাম সাব্বির কাদেরি (যিনি উজ্জ্বলের ভাই)এবং অশোক ঘোষের ডান হাত আনিসুর রহমানের খুনের ঘটনা থেকে এলাকায় রক্তপাতের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। যা যেন থামার নাম নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kankartala criminal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE