Advertisement
E-Paper

হস্টেল-কাণ্ডে তরজায় তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী

রাজনীতির ফাঁসে রাইপুরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আদিবাসী ছাত্রী আবাস। হস্টেলের ভিতরে পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষকে আটকে হেনস্থা করার অভিযোগ থেকে যে জটিলতার সূত্রপাত, তা কাটার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং শাসকদলের দুই গোষ্ঠী মাথা গলানোয় কয়েক সপ্তাহ ধরে একের পর এক জট পাকছে ওই কেন্দ্রীয় ছাত্রী আবাসকে কেন্দ্র করে।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেবব্রত দাস

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০২
হস্টেলে রাজনীতি বন্ধ করার দাবিতে পথে আদিবাসীরা। শুক্রবার বিকেলে তোলা নিজস্ব চিত্র।

হস্টেলে রাজনীতি বন্ধ করার দাবিতে পথে আদিবাসীরা। শুক্রবার বিকেলে তোলা নিজস্ব চিত্র।

রাজনীতির ফাঁসে রাইপুরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আদিবাসী ছাত্রী আবাস।

হস্টেলের ভিতরে পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষকে আটকে হেনস্থা করার অভিযোগ থেকে যে জটিলতার সূত্রপাত, তা কাটার কোনও লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং শাসকদলের দুই গোষ্ঠী মাথা গলানোয় কয়েক সপ্তাহ ধরে একের পর এক জট পাকছে ওই কেন্দ্রীয় ছাত্রী আবাসকে কেন্দ্র করে।

রাইপুরের বিডিও এবং শাসকদলের একাধিক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে থানা অভিযোগ হয়েছে। একাধিক পালটা ‘কেস’ও হয়েছে অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতর পরিচালিত ওই হস্টেলের সুপারের বিরুদ্ধে। একটি কেন্দ্রীয় ছাত্রী আবাসের ঘটনায় একাধিক জনপ্রতিনিধিদের নাম কী ভাবে অভিযুক্তের তালিকায় উঠে এল, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলের এই এলাকায়। পাশাপাশি হস্টেলটিকে ঢাল বানিয়ে রাইপুর ব্লকে শাসক দলের বিবদমান দুই গোষ্ঠী একে অপরের বিরুদ্ধে ময়দানে নেমে পড়েছে। দুই গোষ্ঠীর মাথাদের মধ্যে শুরু হয়েছে চাপানউতোর।

বৃহস্পতিবারই নিরাপত্তার দাবিতে বাঁকুড়া-ঝাড়গ্রাম রাজ্য সড়ক প্রায় তিন ঘণ্টা অবরোধ করে রেখেছিলেন এই হস্টেলের ছাত্রীদের একাংশ। শুক্রবার বিকেলে আবার রাইপুরে পথে নামে ‘রাইপুর মুলুক মাঝি পারগানা জুয়ান মহল’। হস্টেল নিয়ে ‘নোংরা রাজনীতি বন্ধ করতে হবে’, এই দাবি সংবলিত ফেস্টুন হাতে নিয়ে মিছিল করেন ওই সংগঠনের হাজারখানেক সদস্য। রাইপুর সাব-স্টেশন মোড় থেকে মিছিল শুরু হয়ে গোটা ব্লক সদর পরিক্রমা করা হয়। পরে সন্ধ্যায় সবুজ বাজারে একটি প্রতিবাদ সভাও করা হয় সংগঠনের তরফে।

ওই সংগঠনের নেতা বিপ্লব সোরেন ও মিলন মুর্মুদের ক্ষোভ, “এই কেন্দ্রীয় হস্টেলের সুপার প্রতি সপ্তাহে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার ফিরছেন। সুপারের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নানা অব্যবস্থা চলছে হস্টেলে। এরই মধ্যে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে কিছু মহল। আমরা এ সবের বিহিত চাই।” তাঁদের দাবি, হস্টেলে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে উদ্যোগী হোক প্রশাসন। জেলা অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ আধিকারিক স্বরূপ শিকদার বলেন, “বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। সব পক্ষের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনাক্রমের উপরে আমাদের নজর রয়েছে।”

কিন্তু, কেন ছাত্রীদের এক হস্টেল এ ভাবে বারবার সংবাদ শিরোনামে? কী রাজনীতি রয়েছে এর পিছনে?

প্রশাসনিক সূত্রে খবর, কাউকে কিছু না জানিয়ে এই ওই কেন্দ্রীয় হস্টেলের সুপার তাপসী দে-র ছুটি নেওয়াকে কেন্দ্র করেই অশান্তির সূচনা। তাপসীদেবী গত ২ অগস্ট প্রীতিলতা ছাত্রী আবাসের দায়িত্ব নেন। তার পর কিছুদিন তিনি ছুটিতে চলে যান। অভিযোগ, ছুটির ব্যাপারে তিনি জেলার অনগ্রসর শ্রেণি কল্যাণ দফতরকে আগাম কিছু জানাননি। ছুটি কাটিয়ে হস্টেলে যোগ দেওয়ার পরেই তাপসীদেবী সংশ্লিষ্ট দফতরের আধিকারিক স্বরূপবাবুর কাছ থেকে শো-কজ নোটিস পান। সেই মোতাবেক তাঁকে জেলা দফতরে এসে জবাবদিহি করতে হয়। এর পর থেকে ছুটি নিতে হলে তাঁকে রাইপুরের বিডিও-র অনুমতি নেওয়ার নির্দেশও দেন স্বরূপবাবু। পাশাপাশি, বিডিও দীপঙ্কর দাসকে আলাদা ভাবে হস্টেলের উপরে নজর রাখারও নির্দেশ দেন তিনি।

এবং এই ঘটনার পর থেকেই জটিলতা শুরু। যাতে যুক্ত হয়ে যায় শাসকদলের একাংশও। তৃণমূল ও প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এই সময় থেকেই রাইপুরের ব্লক তৃণমূল সভাপতি জগবন্ধু মাহাতোর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা, তৃণমূলের জেলা কমিটির সদস্য অনিল মাহাতোর লোকজনদের পাশে পান তাপসীদেবী। এই পরিস্থিতিতে গত ২২ অগস্ট হস্টেলের অব্যবস্থা নিয়ে সুপারের সঙ্গে কথা বলতে যান রাইপুর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ আশা মণ্ডল। তিনি জগবন্ধুবাবুর অনুগামী বলেই এলাকায় পরিচিত। আশাদেবীকে হস্টেলে আটকে রাখা ও হেনস্থা করার অভিযোগ উঠলে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। পর দিনই তৃণমূলের ওই গোষ্ঠীর লোকেরা হস্টেলের সামনে মঞ্চ বেঁধে ধর্না-অবস্থান আন্দোলন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন জগবন্ধুবাবুও।

আশাদেবী রাইপুর থানায় হস্টেল সুপারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। সুপার খাতড়া আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান। ২৬ আগস্ট রাইপুরের বিডিও তাপসীদেবীর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক নিয়মকানুন না মানা, দুর্ব্যবহার করা-সহ বেশ কিছু অভিযোগ তুলে হস্টেলের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে জানিয়ে থানায় এফআইআর করেন। এর পরেই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। তাপসীদেবীও বিডিও-র বিরুদ্ধে রাইপুর থানায় পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেন। এর পরে পরেই ওই হস্টেলের এক আবাসিক (সারেঙ্গার একটি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী) বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি তথা তৃণমূল নেতা শান্তিনাথ মণ্ডল, রাইপুর কলেজের টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক চিরঞ্জিত মাহাতো, জগবন্ধুবাবুর ছেলে দেবাশিস মাহাতো এবং ছাত্র সংসদের আর এক নেতা তাপস পণ্ডাএই পাঁচ জনের বিরুদ্ধে একাধিক ধারায় খাতড়া আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগে দাবি করা হয়, ওই পাঁচ জন হস্টেলে ঢুকে ঝামেলা পাকিয়েছেন। মেয়েদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন।

শান্তিনাথবাবু, চিরঞ্জিত, তাপসরা জগবন্ধুবাবুর গোষ্ঠীর হওয়ায় দলের একাংশেই প্রশ্ন ওঠে, এই অভিযোগের পিছনে কি অনিল মাহাতো গোষ্ঠীর হাত রয়েছে? কারণ, শেষবার রাইপুরের দু’টি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়াকে ঘিরে অনিলবাবু ও জগবন্ধুবাবুর গোষ্ঠী সংঘাত প্রকাশ্যে এসেছিল। রাইপুর কলেজে দুই গোষ্ঠীর প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জগবন্ধুবাবুর গোষ্ঠীর প্রার্থীরাই ছাত্র সংসদ গঠন করেন। ব্লকের অন্য কলেজ বীরসা মুন্ডা মেমোরিয়াল কলেজে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জগবন্ধুবাবুর প্রার্থীরা জয়লাভ করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে অনিলবাবুর গোষ্ঠীর প্রার্থীদের উপরে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগ উঠেছিল।

তৎকালীন জেলা টিএমসিপি-র সভাপতি তথা বর্তমানে বাঁকুড়া জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গত ছাত্র সংসদের নির্বাচনে অনিলবাবু ও জগবন্ধুবাবুর গোষ্ঠীর মধ্যে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তবে, দলের আদর্শকে মাথায় রেখে দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনা করে সেটা মিটিয়ে নিয়েছিলাম।”

দ্বন্দ্ব যে আদৌ মেটেনি, তা প্রীতিলতা ছাত্রী আবাসের ঘটনাক্রম থেকেই স্পষ্ট। সে কারণেই রাইপুর মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক চিরঞ্জিতকে অভিযোগের তালিকায় নিয়ে আসা হয়েছে বলে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের একাংশের দাবি। ব্লক সভাপতি জগবন্ধুবাবুরও অভিযোগ, “ওই হস্টেল নিয়ে দলেরই একটা গোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ভাবে গণ্ডগোল পাকাচ্ছে। সুপার ও ছাত্রীদের উস্কানি দিচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করানোর জন্য।” তাঁর দাবি, ওই গোষ্ঠীর প্ররোচনাতেই বৃহস্পতিবার পথ অবরোধে নেমেছিলেন হস্টেলের আবাসিক ছাত্রীদের একটা অংশ। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বহিরাগত ছাত্রছাত্রীরাও। পুরোটাই পরিকল্পনা করে করা হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।

অন্য দিকে অনিলবাবুর দাবি, “ব্লকের কিছু প্রশাসনিক আধিকারিক আমাদের দলের এক গোষ্ঠীর ইশারায় চলছে। বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে কর্মাধ্যক্ষের ওই হস্টেলে ঢোকাটাই বেআইনি। তবে, এই ঘটনার সঙ্গে আমরা কোনও ভাবেই জড়িত নই। কাউকে প্ররোচনাও দিইনি।” তাঁর বক্তব্য, হস্টেলের ছাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে প্রশাসন ব্যবস্থা নিক। কর্মাধ্যক্ষ আশা মণ্ডলের অবশ্য দাবি, তিনি হস্টেলের অব্যবস্থার খবর পেয়ে সুপারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। বহিরাগত কেউ তাঁর সঙ্গে ছিল না। হস্টেল সুপার তাপসীদেবীর দাবি, “আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের কথায় কাজ করছি না। তবে হস্টেলের সমস্যার কথা সবাইকে জানিয়েছি।”

raipur rajdeep bondhopadhyai debobrata das
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy