Advertisement
E-Paper

‘পুজোর আবেগে ঘা লাগলে মানুষ ছেড়ে দেবে?’

পুরুলিয়ার বিদায়ী এই জেলা সভাধিপতিকে পাওয়া গেল জেলার সার্কিট হাউসের উল্টোদিকে, তাঁর সরকারি বাসভবনেই। ঘরে কয়েকজন অনুগামী ছিলেন।

সিজার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৮ ১৭:১৯
সৃষ্টিধর মাহাতো।—নিজস্ব চিত্র।

সৃষ্টিধর মাহাতো।—নিজস্ব চিত্র।

গোটা বিছানাটা এলোমেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ফাইল, কাগজপত্র। পাশের দেওয়ালে দড়ি থেকে আলগোছে ঝুলছে জামাকাপড়। বিছানার উপর বাবু হয়ে বসে রোগা পাতলা চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। পরনে লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি। ইনিই সৃষ্টিধর মাহাতো। আড়ালে দলের লোকজন অনেকেই তাঁকে পুরুলিয়ার ‘কেষ্টদা’ বলেন। অন্তত বলতেন এতদিন।

পুরুলিয়ার বিদায়ী এই জেলা সভাধিপতিকে পাওয়া গেল জেলার সার্কিট হাউসের উল্টোদিকে, তাঁর সরকারি বাসভবনেই। ঘরে কয়েকজন অনুগামী ছিলেন। যাওয়ার উদ্দেশ্য শুনেই হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, “হারা মানুষের কাছে আর কী পাবেন?” সত্যিই তো! শাসক দলের এই নেতার চোখের ইশারাতেই গোটা জেলা চলে। আর সেই নেতাই নিজের খাসতালুক বলরামপুরে ভোটে হেরে গেলেন! শুধু নিজে হারাই নয়, গোটা এলাকাতেই কার্যত মুছে গিয়েছে শাসক দল। বাম জমানায়, আদিবাসী-মূলবাসী কমিটির হাত ধরে যে বলরামপুর থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থান হয়েছিল পুরুলিয়ায়, সেই বলরামপুর থেকেই শাসক দলকে মুছে দিয়ে এ বার গেরুয়া ঝান্ডার জয়জয়াকার।

কিন্তু কেন এমন হল? সরাসরি সেই প্রশ্নটাই করলাম সৃষ্টিধরকে।

বাষট্টি বছরের এই দুঁদে রাজনীতিবিদ কয়েক মিনিট ভাবলেন। তার পর হাসতে হাসতেই বললেন, “সোজাসাপ্টা শুনবেন? তা হলে শুনুন—হিন্দুত্বের কাছে হেরে গিয়েছি।”

কিন্তু যে এলাকায় সংখ্যালঘু জনসংখ্যা এক শতাংশেরও কম, সেখানে হিন্দুত্বের জিগিরে সাড়া দিলেন মানুষ? আর জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যেখানে আদিবাসী!

আরও পড়ুন
‘জিতে ফিরলে ওরা হাত কেটে নেবে বলেছিল’

সৃষ্টিধর রীতিমতো হাত নেড়ে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা এখানে ফ্যাক্টর নয়। একটা বিষয় মাথায় রাখুন। বাংলার মানুষের কাছে দুর্গাপুজো একটা আবেগ। সেই আবেগেই ঘা লাগলে মানুষ ছেড়ে দেবে? গ্রাম বাংলায় দশমীর দিনই বিসর্জনের নিয়ম। না হলে, মানুষ সেটাকে অশুভ বলে মনে করে। বিসর্জন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাদের শেষ করে দিল। মানুষ এটা মানতে পারেনি। আর সেটাই জোরদার করেছে হিন্দুত্বের আবেগ।”

দেওয়াল লিখন: ভোট প্রচারে হিন্দুত্বই ছিল বিজেপি-র বড় ইস্যু। পুরুলিয়ার ঘাটবেড়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

সৃষ্টিধর কথা শেষ করার আগেই তাঁর পাশে বসা বলরামপুরেরই এক তৃণমূল নেতা বলে উঠলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নমাজ পড়ার ছবি নিয়েও বিজেপির প্রচার কাজে এসেছে।” শুনে সৃষ্টিধর মুচকি হাসলেন। মেনে নিলেন, “এই জমানায় সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে সরকারি অনুদানও সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি।”

কিন্তু সেই অনুদান তো সারা রাজ্যেই দেওয়া হয়েছে। তা হলে পুরুলিয়াতেই প্রভাব পড়ল কেন?

প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি এ বার আরও অকপট— “সম্প্রতি আড়শার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পরপরই যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল তাও ঠিক হয়নি।” কী হয়েছিল সেই সময়? এ বার জবাব পেলাম সৃষ্টিধরের অন্য এক অনুগামীর কাছ থেকে। তাঁর কথায়, “সংঘর্ষের পরের দিন যে ভাবে আমাদের সব নেতারা সংখ্যালঘু এলাকায় মিছিল করল, তা মানতে পারেননি বাকি মানুষরা।” এই সব কারণেই হাত শক্ত হয়েছে হিন্দুত্বের।

আরও পড়ুন
দুলাল আত্মঘাতীই, বলছে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট, মানতে নারাজ পরিবার

রাজনৈতিক জীবনের শুরু কংগ্রেস কর্মী হিসাবে। তৃণমূলের জন্ম থেকেই সেই দলের কর্মী। ব্যবসায়ী পরিবার। নিজের ইটভাটা আছে। বাড়ি অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে উরমার কাছে। ছেলে সুদীপ দলের বলরামপুর ব্লক সভাপতি। গোটা এলাকা হাতের তালুর মতো চেনেন। তাও তিনি আগাম আঁচ পাননি যে তাঁর পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে। স্বীকার করলেন তিনি নিজেও, “গণনা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত সত্যি বুঝতে পারিনি যে হারব।”

বিরিঞ্চি কুমার (নীল জামা পরা), সঙ্গে বাইকে সওয়ার সঙ্গীসাথীরা।—নিজস্ব চিত্র।

আর তাই তাঁর খাসতালুকেই বাইকের ধুলো উড়িয়ে এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ২১ বছরের বিরিঞ্চি কুমার। সঙ্গে বাইকে সওয়ার সঙ্গীসাথীরা। বলরামপুর কলেজে ভর্তি হলেও লেখাপড়া শেষ না করেই রাজনীতিতে। বিরিঞ্চ বলরামপুর ব্লকে বজরং দলের প্রধান। পরনে নীল সিল্কের পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট। পায়ে স্নিকার। কবজিতে মোটা রুপোর চেন। বললেন, “আমার এক ডাকে ১৫ হাজার ছেলে বেরোবে। এখানে বিজেপি বলে কিছু নেই। সবটাই আমরা। বিজেপি জিতেছে আমাদের জন্য।”

বিরিঞ্চির একটাই কথা, “আমরা রাজনীতি বুঝি না। আমরা জানি খালি হিন্দুত্ব। আমরা দেড় বছরে এলাকায় চারটে রাম মন্দির তৈরি করেছি।” হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করেই ২১ বছরের বিরিঞ্চি এখন সৃষ্টিধরের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি নিজেও এ বার পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপির টিকিটে জিতেছেন।

দলের আরও অনেক সিদ্ধান্তও যে তাঁদের বিরুদ্ধে গিয়েছে, তাও আকারে ইঙ্গিতে বোঝালেন সৃষ্টিধর। পুরুলিয়া জেলাতে সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষক পদে ১ হাজার ৮০০ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ১ হাজার জনই অন্য জেলার। সৃষ্টিধরের সামনেই তাঁর এক অনুগামীর খেদোক্তি, “এর পর আমার জেলার লোক আমাদের ভোট কেন দিবে?”

এই বর্ষীয়ান নেতা ভাল ভাবেই জানেন, তাঁর সামনের রাস্তা আর মসৃণ নয়। হারের পর থেকেই তাঁর কাছে লোকজনের আসা কমে গিয়েছে। এলাকাতেও অনুগামীরা সন্ত্রস্ত। দলেও কোণঠাসা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের ফল ঘোষণার পরই কলকাতায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আর সে দিনই কলকাতা থেকে দু’লাখ টাকা দিয়ে নিজের আত্মরক্ষার জন্য কিনেছেন বিদেশি পিস্তল। কারণ তিনি জানেন, ক’দিন পরেই তিনি আর সরকারি নিরাপত্তা আর না-ও পেতে পারেন। পাহাড়ের ঢালে তাঁর যেখানে বাড়ি, সেই এলাকা সামনের দিনে আর কতটা নিরাপদ থাকবে তা নিয়েও তাঁর যথেষ্ট সংশয় আছে।

Bengal Panchayat Election 2018 Panchayat Election Mamata Banerjee Sristidhar Mahato Purulia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy