Advertisement
E-Paper

‘প্রাসাদ-রাজকন্যা’ ছেড়ে কি সন্ন্যাসের পথে মন্ত্রী, নাকি ঘুঁটি সাজানো হচ্ছে অন্য দরবারে?

অন্য কোনও ‘রাজদরবারে’ কি ঘুঁটি সাজানো চলছে? পূর্ব বেহালার মুকুটহীন রাজা তথা মমতার রাজত্বের সদ্যপ্রাক্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে এই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ১০:৫১
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বনিবনা কমে আসছিল। ‘প্রাসাদ’, ‘রাজকন্যা’— সব ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন মন্ত্রী। এ বার মন্ত্রিত্বও ছেড়ে দিলেন। বাংলার ‘রাজদরবার’-এর সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্কও কি চুকিয়ে দেবেন? অন্য কোনও ‘রাজদরবারে’ কি ঘুঁটি সাজানো চলছে? পূর্ব বেহালার মুকুটহীন রাজা তথা মমতার রাজত্বের সদ্যপ্রাক্তন মন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে এই প্রশ্নই এখন সবচেয়ে বড়।

বেহালা পূর্বের বিধায়ক অনেক পরে হয়েছেন শোভন। তার অনেক আগে থেকে কাউন্সিলর। বেহালার অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে একটানা প্রায় সাড়ে তিন দশক কাটিয়ে ফেলেছেন কলকাতা পুরসভায়।

আর পাশেই যে মহেশতলা, সেখানকার প্রবীণ রাজনীতিক তথা দাপুটে ব্যবসায়ী হলেন দুলাল দাস, শোভনের শ্বশুর। তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণের কারণে দুলাল দাস এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষমতাবান নিজের এলাকায়। মহেশতলার চেয়ারম্যানও তিনি, বিধায়কও তিনি। তৃণমূলেরই কেউ কেউ তাই আজকাল ‘মহেশতলার রাজকন্যা’ নামে ডাকছেন রত্না চট্টোপাধ্যায়কে। সামনে নয় অবশ্য, আড়ালে-আবডালে।

ইতিহাসের পাতায় আজকের তারিখ, দেখতে ক্লিক করুন — ফিরে দেখা এই দিন

আরও পড়ুন

অন্যের ইশারায় কাজ করায় এই হাল, নিজেই নিজেকে শেষ করলেন শোভন: রত্না

সেই ‘রাজকন্যা’র সঙ্গে বেহালার ‘মুকুটহীন রাজা’র বিচ্ছেদের মামলা এখন আদালতের বিচারাধীন। কিন্তু দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকাংশটাতেই যাঁর ছত্রছায়ায় থেকে কাজ করে এসেছেন শোভন, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বিচ্ছেদ যেন আশু। মঙ্গলবারের ঘটনার পর তেমন ধারণাই তৈরি হয়েছে গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে।

বেহালায় নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি ছেড়ে শোভন চট্টোপাধ্যায় চলে গিয়েছেন অনেকগুলো দিন আগেই। দক্ষিণ কলকাতারই অন্য অংশে থাকছেন একটি ফ্ল্যাটবাড়িতে। সেই ফ্ল্যাটবাড়ির সামনের ফুটপাতে শতরঞ্চি বিছিয়ে যে দিন ধর্নায় বসেছিলেন রত্না, সে দিনই খুল্লমখুল্লা হয়ে গিয়েছিল দাম্পত্যের টানাপড়েন। কলেজ শিক্ষিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্ক নিয়ে নানা ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিলেন রত্না। আর শোভন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কোনও মূল্যেই আর রত্নার সঙ্গে থাকবেন না তিনি। মঙ্গলবার শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভাতেও আর থাকছেন না তিনি। টানাপড়েনের উৎস সেই একই— তথাকথিত ত্রিকোণ।

আরও পড়ুন

অনেক সুযোগ দিয়েছিলেন মমতা, কিন্তু শোধরাননি শোভন

বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘বিশেষ বন্ধুত্বের ’ মাশুল গুনতে হল সোভন চট্টোপাধ্যায়কে।

শোভনের সমালোচকরা বলছেন, ‘প্রেমে হাবুডুবু উনি, তাই ভাল-মন্দের বাছবিচার করতে পারছেন না আর।’ নতুন নয়, অনেক দিন ধরেই এ কথা বলা হচ্ছে। শোভন সে সম্পর্কে কোনও প্রতিক্রিয়া দেননি। শুধু বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, রত্নার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাঙার কারণ বৈশাখী নন, বৈশাখী তাঁর বিপদের বন্ধু মাত্র। কিন্তু রত্নার সঙ্গে সম্পর্কে এত টানাপড়েন কেন, তা নিয়ে কোনও মন্তব্য তিনি করতে চাননি। ইঙ্গিত দিয়েছিলেন একবার বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। শোভনের বিরুদ্ধে, সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেই একই অভিযোগ আসলে রয়েছে সম্পর্কের অন্য প্রান্তে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে— আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেই এমনটা বলেছিলেন বৈশাখী। তবে শোভন নিজে বিষয়টা খোলসা করে না বলা পর্যন্ত তিনি সংবাদমাধ্যমকে এর চেয়ে বেশি কছু বলবেন না বলেও বৈশাখী সে দিন জানিয়েছিলেন।

শোভন সংবাদমাধ্যমকে না বলুন, ‘দিদি’কে তো জানাতেই পারতেন। বৈশাখীর দাবি, দিদি সব জানেন, দিদিকে জানিয়েই শোভন বাড়ি ছাড়েন। তা-ই যদি হয়, তা হলে শোভন-রত্নার টানাপড়েন বা শোভন-বৈশাখীর তথাকথিত সম্পর্ক নিয়ে দিদি এত বিব্রত কেন? এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু মিলছে না।

শোভনের সঙ্গে আলাপ হওয়ার অনেক আগে থেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল বলে বৈশাখীর দাবি। পরে শোভনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ক্রমশ তৃণমূলের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সংগঠনের অন্যতম শীর্ষনেত্রী হয়ে ওঠেন বৈশাখী। ওই সংগঠন মূলত পার্থ চট্টোপাধ্যায়ই দেখভাল করেন। আবার শোভনের হাতে থাকা পুরসভার গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতেও বৈশাখী জায়গা পান। কিন্তু যে দিন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন যে, শোভন-বৈশাখীর সম্পর্ককে তিনি ভাল চোখে দেখছেন না, সে দিন থেকেই তৃণমূলের অন্দরে বৈশাখীর অধোগতি শুরু হয়ে যায়। ‘বিপদের বন্ধু’র পাশে থাকতে চাওয়া শোভনকেও মাশুল গোনা শুরু করতে হয়।

বৈশাখী প্রসঙ্গে আড়ালে-আবডালে শোভনকে কতবার ধমকেছেন মমতা, তা জানার উপায় কম। কিন্তু বিধানসভা ভবনে এক দিন প্রকাশ্যে ‘কাননের’ দিকে ‘দিদি’ প্রশ্ন ছুড়েছিলেন— শুধু প্রেমই চলছে, নাকি কাজটাজও কিছু হচ্ছে? সর্বসমক্ষে অপ্রত্যাশিত ধাক্কা! শোভন হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। সে দিন জবাব খুঁজে পাননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আর খুব বেশি অস্বস্তি বাড়াননি সে দিন।

তৃণমূল সূত্রের খবর, মমতা আশা করেছিলেন, সর্বসমক্ষে তিনি প্রশ্নটা হালকা মেজাজে করলেও, তাঁর বার্তা শোভন বুঝে যাবেন, তিনি ‘শুধরে’ যাবেন। কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে একাধিক বার বলেছেন, শুধরনোর কিছুই নেই, কারণ তিনি কোনও অন্যায় করছেন না।

আরও পড়ুন

বৈশাখী বিতর্কে শেষ পর্যন্ত সরতেই হল শোভনকে

শোভনের ডানা ছাঁটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। পরিবেশ দফতর তাঁর হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাঁর নিরাপত্তার বহরে কাটছাঁট হয়েছিল। ক্রমে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কেড়ে নেওয়া হয় তৃণমূলের পুরদলের দায়িত্বও। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরেও নেমে এসেছিল কোপ। প্রথমে ওয়েবকুপার গোটা কমিটিই ভেঙে দেওয়া হয়। তার পরে ওয়েবকুপা থেকে বৈশাখীকে সরিয়েও দেওয়া হয়।

এ সবের ফাঁকেই এক দিন ক্যাবিনেট বৈঠকের শেষে ফের গোটা মন্ত্রিসভার সামনে শোভনকে ধমকান মমতা। নবান্ন সূত্রে তেমনই খবর মিলেছিল। বৈশাখীর সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গেই মূলত সেই ধমক ছিল বলে খবর। শোভন সে দিন আর নিরুত্তর থাকেননি, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে সর্বসমক্ষে কেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করবেন— এমন প্রশ্নই তিনি তুলেছিলেন। দাবি শোভন ঘনিষ্ঠদের। সে দিন বিতণ্ডা খুব বেশি দূর গড়ায়নি। কিন্তু মঙ্গলবার বিধানসভায় স্পিকারের ঘরে দিদির সঙ্গে কাননের বিতণ্ডা তুঙ্গে পৌঁছয় বলে জানা যাচ্ছে। বৈশাখীর নাম করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন কি‌ছু বলেননি। কিন্তু শোভন কাজে মন দিচ্ছেন না, তিনি শাড়ি-গয়নার দোকানেই বেশি সময় কাটাচ্ছেন— এমন সব মন্তব্য ছিল বলে শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি। মুখ্যমন্ত্রীর প্রায় প্রতিটি কথারই জবাব দিতে শুরু করেন শোভন এবং তাতেই উত্তেজনা বেড়ে যায় বলে খবর।

তখন সুখের দাম্পত্য। স্ত্রী রত্নার সঙ্গে শোভন।

শোভনের হাতে থাকা আবাসন দফতরের কাজে মুখ্যমন্ত্রী অসন্তুষ্ট এবং সেই বিষয়ে কথা বলতেই শোভনকে স্পিকারের ঘরে মঙ্গলবার মমতা ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তৃণমূল সূত্রে এমনই জানা যাচ্ছে। সেই নিয়েই তর্ক শুরু হয়ে যায় বলে খবর। কিন্তু শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি, ধীরে ধীরে শোভনের ডানা ছাঁটা হচ্ছিল। আবাসন দফতরের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা আসলে সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ ছিল, আবসন দফতর কেড়ে নেওয়ারই উপক্রমণিকা ছিল। শোভন সে সুযোগ না দিয়ে সব মন্ত্রিত্ব একেবারেই ছেড়ে দিলেন।

বিধানসভায় স্পিকারের ঘরে কোনও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে কি না, হলে তা ঠিক কী নিয়ে হয়েছে, শোভন চট্টোপাধ্যায় এ ভাবে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন কেন— এ সব বিষয়ে তৃণমূলের তরফে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা শোভন চট্টোপাধ্যায়ও প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে তৃণমূলের অন্দরে আবার সেই সিবিআই তত্ত্ব নিয়ে চর্চা বাড়তে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

নতুন মেয়র বসাতে আইন বদলের চিন্তা

কী সেই তত্ত্ব? যিনিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সেকেন্ড ম্যান’ হয়ে উঠবেন, তাঁকেই তৃণমূল ছাড়ার দিকে এগিয়ে যেতে হবে, ‘সিবিআই লেলিয়ে দিয়ে’ তাঁদের তৃণমূলছাড়া হতে বাধ্য করবে বিজেপি— এমনই চর্চা শোনা যাচ্ছে। তৃণমূলের কোনও মন্ত্রী বা কোনও রাজ্য স্তরের নেতা অবশ্য এই রকম কোনও মন্তব্য প্রকাশ্যে করেননি। তবে দক্ষিণের তৃণমূল নেতা তথা টেলিভিশনের প্যানেলে তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিত মুখ সোমনাথ সিংহরায় অকপট। বললেন, ‘‘বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিজেপির এজেন্ট নন, এমনটা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। মুকুল রায় ছিলেন দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা। তাঁকে সিবিআই দেখিয়ে তৃণমূল ছাড়তে বাধ্য করা হল। মুকুল রায় যাওয়ার পরে শোভন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দিদির সেকেন্ড ম্যান। তাঁকেও সিবিআই জুজু দেখানো হল। তার পরে একটু অন্য পথে তিনিও দিদির থেকে দূরে সরে গেলেন। বৈশাখীকে কেন বিজেপির এজেন্ট বলে সন্দেহ করছি, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।’’

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবরআমাদের রাজ্য বিভাগে।)

Mamata Banerjee Baishakhi Banerjee Trinamool Congress TMC BJP Sovan Chatterjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy